বাংলাদেশেই এভাবে খোলা আকাশের নিচে নারী-পুরুষ ‘বেচা-কেনা’ হয়

গুরুদাসপুরের ওই শ্রমিক হাটে পুরুষদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরাও শ্রম বিক্রি করতে আসে। শরীরটা চাদরে মোড়ানো। হাতে কাস্তে-কোদাল। কাঁধে ধান বাহনের বাক। এসব সরঞ্জামাদি নিয়ে ষাটোর্ধ দিনমজুর আছির মিয়া নিজেকে হাটে তুলে ধরেছেন শ্রম বিক্রি করার জন্য। সময় তখন ভোর ৫টা। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় রীতিমতো যুবুথুবু অবস্থা।

দিনমজুর আছির মিয়ার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার দবিরগঞ্জ এলাকায়। ভোর ৪টায় পাঁচ টাকা ভাড়ায় ট্রাকে চড়ে এসেছেন নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের নয়াবাজার শ্রমিকের হাটে। এই হাটে শুধু যে আছির মিয়া এসেছেন তা নয়। প্রকৃতির সব প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে জীবিকার তাগিদে আশপাশের কয়েকটি জেলা থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক এসেছেন শ্রম বিক্রি করতে। কিন্তু মেলেনি ন্যায্য মজুরি। শ্রমিকের এই কাতারে রয়েছে নারী-শিশুসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী-পুরুষরাও।

কৃষকদের তথ্যমতে- দক্ষিণ চলনবিলের নাটোরের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, সিংড়া, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও পাবনার চাটমোহর উপজেলায় বিনাহালে রসুন রোপণ আর আমন ধান কাটার উৎসবকে ঘিরে প্রতিদিন হাজারো শ্রমিক বসে এই শ্রমিকের হাট ঘিরে।

কৃষি অধিদফতর ও স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চলনবিলের পানি এখন ভাটি অভিমুখী। জেগে উঠছে আবাদি জমি। দক্ষিণ চলনবিলের প্রায় ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে চলছে ধান কাটার উৎসব। ধান কাটার পর নরম-কর্দমযুক্ত পলিমাটিতে শুধু নাটোরের সাতটি উপজেলায় ২৫ হাজার ৭শ’ ৯৫ হেক্টর জমিতে বিনাহালে রসুন রোপণের কাজ শুরু হয়েছে। এসব কাজের চাহিদা মেটাতে চলনবিলের নিচু এলাকার শ্রমিক এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শ্রমিকরাই এই শ্রমিকের হাটে আসে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে নয়াবাজারের শ্রমিকের হাটে গিয়ে দেখা যায়, গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম ছাড়াও তাড়াশ, সলঙ্গা ও উল্লাহপাড়া বগুড়া শেরপুর উপজেলা এলাকার শ্রমিকরা দল বেঁধে এখানে জমায়েত হয়েছেন। এসব শ্রমিকদের সবাই এসেছেন ট্রাক-বাসের ছাদে, নছিমন কিংবা অটোভ্যানে। সকলের গায়েই রয়েছে শীতের পোশাক, হাতে কাস্তে, কোদাল ও ধান বহনের জন্য বাক। পাশ দিয়েই সাঁই সাঁই করে চলছে বাস-ট্রাক। গেরস্থ (কৃষক) দেখলেই- শ্রমিকদের প্রশ্ন ‘কয়ড্যা লাগবি’ (কয়জন শ্রমিক লাগবে)। কৃষক তাদের চাহিদামত শ্রমিক দরদাম মিটিয়ে সরাসরি নিয়ে যাচ্ছেন মাঠে।

রাসেল শাহসহ পাঁচজন কৃষকের সাথে কথা বলে জানাগেছে, বিনাহালে রসুন রোপণ, সেখানে লারা (ধানের খড়) বিছানো ও ধানকাটাসহ জমি তৈরির কাজ করানো হয় বহিরাগত এসব শ্রমিক দিয়ে। স্থানীয় শ্রমিকের মজুরি ৩৫০ টাকা। অথচ একই কাজ করে বহিরাগত শ্রমিকদের দিতে হয় ২৮০ থেকে ৩শ’ টাকা। তুলনামূলক কম মজুরীতে কাজ করায় এসব শ্রমিকের চাহিদা বেশি। নভেম্বরের শুরু থেকে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত চলে শ্রমিকদের এই হাট। এতে এঅঞ্চলের কৃষকরা বেশ সুবিধা পাচ্ছে।

ধারাবারিষা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন ইত্তেফাককে জানান, শুধু নয়াবাজার নয় বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক ঘেঁষে মশিন্দা ইউনিয়নের হাঁসমারী ও বড়াইগ্রামের মানিকপুর পয়েন্টে এরকম শ্রমিকের হাট বসছে প্রায় দশ বছর ধরে। তার তথ্যমতে, দক্ষিণ চলনবিলের পানি আগে নামে। একারণে ধান কাটা এবং বিনা হালে রসুন শুরু হয়। আর এসব আবাদকে ঘিরে এই শ্রমিকের হাট বসছে।

গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম বলেন, গুরুদাসপুর উপজেলাসহ আশপাশের বড়াইগ্রাম ও চাটমোহর, তাড়াশ উপজেলাতে বিনাহালে রসুন আবাদ শুরু হয়েছে। এসব আবাদকে ঘিরে বিভিন্ন উপজেলা এলাকা থেকে শ্রমিকরা গুরুদাসপুরের এই শ্রমিকের হাটে জড়ো হন। একারণে এঅঞ্চলের কৃষকদের বেশ সুবিধা হচ্ছে। সহজে শ্রমিক পাওয়ায় সময়মতো আবাদ করতে পারছেন কৃষক।