বাংলাদেশের মানুষের রক্ত আর শরীরে সুপারবাগ

বাংলাদেশে সুপারবাগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে বলে মনে করছেন গবেষকরা৷ শুধু হাসপাতালের আইসিইউ নয়, সুস্থ মানুষের রক্ত ও শিশুদের শরীরে সুপারবাগের অস্তিত্ব মিলছে৷ এমন অনুজীব ছড়িয়ে পড়েছে পরিবেশেও৷

জ্বর, ডায়রিয়া বা গলা ব্যথার চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত একটি অ্যান্টিবায়োটিক অ্যাজিথ্রোমাইসিন৷ দেশের ফার্মেসিগুলোতে এই গ্রুপের ঔষধ হরহামেশাই পাওয়া যায়৷ অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই তা কিনে নিচ্ছেন, কিংবা ঔষধের দোকানদাররাও দ্রুত অসুখ সারবার জন্য তা খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন৷ সমস্যা হলো, প্রয়োজন আর মাত্রা না বুঝেই রোগীরা এই ঔষধ সেবন করছেন৷ শুধু অ্যাজিথ্রোমাইসিন নয়, একই কথা খাটে শরীরের কাটা-ছেঁড়া ভালো করবার জন্য ব্যবহৃত পেনিসিলিন বা ডায়রিয়ার জন্য প্রযোজ্য মেট্রোনিডাজলের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রেও৷ অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারে এইসব প্রাথমিক অ্যান্টিবায়োটিকগুলো এখন কার্যকারিতা হারিয়েছে৷ ভয়াবহ তথ্য হলো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী যেসব অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে, সেগুলোতেও এখন জীবানুদের নিঃশেষ করা যাচ্ছে না৷

ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ-আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও মোলিকিউলার ইকোলোজি অ্যান্ড ম্যাটাপজেনোমিক ল্যাবরেটরির প্রধান মনিরুল আলম বলেন, ‘‘রোগ জীবাণুর যে অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীলতা, তা আশংকাজনকভাবে বেড়েছে৷ ডায়রিয়ার জীবানু বা যে-কোনো ধরনের ইনফেকশন তৈরির জন্য যেসব ব্যাকটেরিয়া বা অনুজীব আছে, সেগুলো প্রত্যেকটিই এখন মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট, যেটাকে আপনারা বলতে পারেন সুপারবাগ৷” অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীল জীবাণু বা সুপারবাগ নিয়ে গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েকটি গবেষণা করেছে৷ তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো অনেক তথ্যই উঠে এসেছে৷

‘সাধারণ জীবাণুগুলোই ভয়ংকর মৃত্যুদূত হিসেবে কাজ করছে’

২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ১০৩,৬৭৯ বোতল রক্তের নমুনা পরীক্ষা করেছিল আইসিডিডিআর,বি৷ তার মধ্যে ১৩ দশমিক ৬ ভাগ রক্তেই রোগের জীবাণুর সংক্রমণ পাওয়া গেছে৷ এর ৭২ দশমিক ১ ভাগই ছিল মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট বা বহুবিধ অ্যান্টিবায়োটিক সহনশীল৷ ২০১৭ সালে চলমান এই গবেষণাটি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়৷ মনিরুল আলম বলেন, ‘‘ব্লাডে নরমালি কোনো অরগানিজম থাকার সুযোগ নেই৷ শরীরে রক্তের মধ্যে যখন ব্যাকটেরিয়া চলে যায়, সেটা তখন ভয়ংকর৷ অর্থাৎ, আপনি যদি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করতে পারেন, তাহলে এই ব্লাডের ব্যাকটেরিয়াকে মারার আর কোনো পথ থাকবে না৷ এর ফলে ঐ ব্যাকটেরিয়াই আপনাকে মারবে৷ এই ব্যাকটেরিয়াগুলো থ্রো আউট স্টাডি পিরিয়ডে পাওয়া গেছে, এটি খুব আশঙ্কাজনক একটি অবস্থা৷”

গবেষণাটির ফলাফল বলছে আগে ক্ষতিকর ছিল না এমন ব্যাকটেরিয়াও এখন সুপারবাগে পরিণত হয়েছে, যা মানুষের রক্তে মিশে গেছে৷ ‘‘এই সমস্ত সহজ সাধারণ জীবাণুগুলোই ভয়ংকর মৃত্যুদূত হিসেবে কাজ করছে,” উল্লেখ করেন মনিরুল৷

এ তো গেল সাধারণ জীবাণুর কথা৷ যেসব রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসাই করা হয় অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে, তার পরিস্থিতি আরো ভয়ানক৷ যেমন নাইসেরিয়া গনোরিয়া৷ এই ধরনের রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে সেফট্রিয়াক্সনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক

আগে শতভাগ কাজ করত৷ কিন্তু জীবাণুও এখন সেটি প্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে৷ রোগীদের উপর পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির আরেক গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে৷ বিষয়টি উল্লেখ করে মনিরুল বলেন, ভবিষ্যতে যখন কেউ গনোরিয়ায় আক্রান্ত হবে, অবধারিতভাবেই তার জীবন শংকায় থাকবে৷

শিশুদের শরীরেও সুপারবাগ

সাধারণত শিশুরা ভয়াবহ কোনো রোগে আক্রান্ত না হলে তাদেরকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয় না৷ মনিরুল জানান, ‘‘মারাত্মক ডায়রিয়া নিয়ে যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়, তখন তাদেরকে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক রিকমান্ড করে থাকি৷ তা-ও এক থেকে তিন দিনের একটা ডোজ দেয়া হয় অ্যাজিথ্রোমাইসিনের, যদি এটা কলেরা বা পাতলা পায়খানা হয়ে থাকে৷ নিউমোনিয়া বা এই ধরনের সিরিয়াস কিছু না হলে বাচ্চাদের অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয় না৷” তাঁর মতে, এ কারণে তাদের দেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর উপস্থিতিও কম থাকবার কথা৷ কিন্তু আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শিশুদের শরীরে স্বাভাবিকভাবে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোর ৭৫ ভাগই মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট বা সুপারবাগে পরিণত হয়েছে৷ তিনি বলেন, মানুষের পেটের ভেতরে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে৷ সেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক্ষম হয়ে যাওয়াটা ভয়ংকর একটি ব্যাপার৷ যাদের পরীক্ষা করা হয়েছে শুধু তারাই নন, সারাদেশের মানুষের ক্ষেত্রেই এমন পরিস্থিতি হতে পারে বলে ধারণা তাঁর৷

সুপারবাগ যখন হাসপাতালে

হাসপাতালের ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউ-তে ভর্তি কিংবা বার্ন ইউনিটের আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় উচ্চ ক্ষমতার অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়৷ কিন্তু হাসপাতালেই এখন সুপারবাগের সংক্রমণ হচ্ছে, যার কারণে সবচেয়ে উচ্চক্ষমতার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও রোগীকে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচানো যাচ্ছে না৷ সম্প্রতি এ নিয়ে ব্রিটেনের ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে৷ ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সায়েদুর রহমান সেখানে বলেছেন, ২০১৮ সালে এই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ৯০০ রোগীর ৪০০ জনই মারা গেছেন৷ তাঁদের ৮০ শতাংশই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত ছিল৷

ঢাকার হাসপাতালগুলোর আশেপাশের পানির নমুনা পরীক্ষা করে ৭১ ভাগ ক্ষেত্রেই ‘এনডিএম ওয়ান প্রোডিউসিং ব্যাকটেরিয়া’ বা এক ধরনের শক্তিশালী সুপারপাবাগের অস্তিত্ব পেয়েছে আইসিডিডিআর,বি৷ এ বিষয়ে মনিরুল ইসলাম জানান, ‘‘এরা খুব ভয়াবহ ধরনের একটা ব্যাকটেরিয়া৷ এটা যে-কোনো অরাগানিজমে থাকতে পারে৷ এবং একটা থেকে আরেকটায় ট্রান্সমিট করতে পারে৷ অর্থ হলো, যত রকমের গ্রুপ অফ অ্যান্টিবায়োটিক আছে, তার সবগুলোই মোটামুটি এরা প্রতিরোধ করতে পারে৷ কাজেই হাসপাতালের চারপাশে বা হাসপাতালে যখন এনডিএম প্রোডিউসিং ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যাচ্ছে, তার মানে, হাসপাতালের রোগীকে যত ধরনের পাওয়ারফুল অ্যান্টিবায়োটিকই দেন না কেন, সেই অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করবে না এবং সেটাই হচ্ছে৷”

শুধু হাসপাতালে নয়, সুপারবাগের অস্তিত্ব পেয়েছেন তারা ঢাকার জলজ উৎস, এমনকি গ্রামের মাটিতেও৷ ‘‘বাড়ির উঠানে বা আশেপাশেও যে মাটি, সেখানেও কুইনোলন রেজিস্ট্যান্টের মতcf ভয়াবহ রেজিস্ট্যান্স জিন পাওয়া যাচ্ছে৷ সাধারণ ব্যাকটেরিয়াও যখন এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া অ্যকোয়ার করতে পারে, সে তখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে যায়৷ সাধারণ একটা ইনফেকশন করবে, সেটা তখন আর সারবে না, তার থেকেই মানুষের জীবন সংহার হবে,” বলেন মনিরুল৷

কেন এমন হচ্ছে

যখনই নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আসছে, জীবাণুরাও ক্রমশ তার প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করছে, হয়ে উঠছে সুপারবাগ৷ এজন্য গবেষকরা খুব প্রয়োজন না হলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন৷ মনিরুল বলেন, ‘‘নরমাল সর্দি-কাশি হলে আমরা অ্যান্টিবায়টিক খাচ্ছি৷ ডায়রিয়া হলেও আমরা অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছি৷ এই ব্যবহার স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে নেই৷ যেসব ব্যাকটেরিয়াকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে মারার চেষ্টা করি, তাদের কিন্তু বেচে থাকার চেষ্টা আছে৷ তারা খুবই শক্তিশালী এবং সহজেই অ্যান্টিবায়োটিকে সহনশীল হয়ে যেতে পারে৷”

কিন্তু এখন শুধু মানুষ নয়, এমনকি গবাদি পশুর খামার আর পোল্ট্রি শিল্পেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়৷ ২০১৬ সালে দেশের বিভিন্ন জেলার ৭৩ টি পোল্ট্রি খামারে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, প্রত্যেকটিতেই কোনো-না-কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হচ্ছে৷ ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে এমনকি কলিস্টিনের মতো উচ্চ ক্ষমতার অ্যান্টিবায়োটিকও দেয়া হচ্ছে৷ এসব অ্যান্টিবায়োটিক পরিবেশে মিশে গিয়ে সমস্ত জীবণুকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলছে৷ ‘‘তারাই পরবর্তীতে আবার আমাদের ভেতরে আসছে, আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইনফেকশন করে আমাদের শরীরে ফিরে আসছে, ” বলেন মনিরুল৷

এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকরা৷ তাঁরা বলছেন, হাসপাতালে পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারপরই কেবল অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া যেতে পারে৷ সার্টিফায়েড রেজিস্টার ফার্মাসিস্ট এবং ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া যাতে ঔষধ বিক্রি না হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তাঁরা৷

এ নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সম্প্রতি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট৷