বাংলাদেশে কি শিশুরা অনিরাপদ হয়ে পড়ছে?

বাংলাদেশে রাজশাহীর বাগমারায় বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ঘুমন্ত অবস্থায় এক শিশুকে জবাই করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করছে শিশুটির পরিবার।

মধ্যরাতে আতিকুর রহমান মিঠুনের ছয় বছর বয়সী ছেলের চিৎকারে ঘুম ভাঙে পরিবারের সবার।

আলো জ্বেলে দেখা যায়, শিশুটির গলায় কাটা চিহ্ন। তড়িঘড়ি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ায়, শিশুটি এ যাত্রা বেঁচে গেছে।

শুক্রবার দুপুরে শিশুটির গলায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।

মিঃ রহমান বলছেন, “ছেলের চিৎকার শুনে উঠে দেখি, গলা কাটা। ওর মা রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। ওখানে ডাক্তারের কাছে নিয়েছি, দেখে বলছে, আমি হাত দিতে পারবো না।

পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখানে ডাক্তার বলছে, তীক্ষ্ণ ধারালো কিছু দিয়ে টান দেয়া হয়েছে গলায়।”

মিঃ রহমান জানিয়েছেন, তাদের কোন পূর্বশত্রুতাও নেই, কেন এমন একটি ঘটনা ঘটলো, তা তার ধারণার বাইরে।

এখন সন্তানের জীবন নিয়ে তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন।

যদিও, বাগমারার পুলিশের ধারণা, ঘরের ড্রেসিং টেবিলের কাঁচ ভেঙ্গে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

শিশু নির্যাতনের হার কি বাড়ছে?

বাংলাদেশে জুলাই মাসের মধ্যে এটি তৃতীয় ঘটনা যেখানে শিশুদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা জানা গেল।

এর আগে মাত্র বৃহস্পতিবারে নেত্রকোনায় এক শিশুর কাটা মাথা নিয়ে পালাতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে এক যুবক।

এ মাসের শুরুতে ঢাকার ওয়ারীতে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় আরেক শিশুকে।

ফলে অভিভাবকেরা সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

ঢাকায় একজন নিম্নবিত্ত কর্মজীবী মা রেবেকা সুলতানা বলছেন, “আমার তো উপায় নাই, বাসায় বাচ্চা একা রেখে কাজে আসি। এখন টিভিতে এইসব ঘটনা দেখে ও শুনে খুবই চিন্তায় আছি।”

আরেকজন মা বলছিলেন, “বাচ্চার নিরাপত্তা নিয়ে আমার সারাক্ষণ ভয় লাগে। কারণ আমার স্বামী নাই।

শুধুমাত্র আমার বাচ্চার সাথে থাকার জন্য টাঙ্গাইল থেকে মাকে এনে রেখেছি নিজের কাছে। আমার খরচও বেড়েছে এজন্য, কিন্তু কিছু তো করারও নাই আমার।”

শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলো বলছে, বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছর শিশুদের ওপর সহিংসতা অর্থাৎ ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং হত্যাসহ নানা রকম সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সেভ দ্য চিলন্ড্রেনের এক হিসাব বলছে, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে সারাদেশে ৫৩৯জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এদের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৫জন শিশুকে।

এ সময়ের মধ্যে ৮২জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে।

সেভ দ্য চিলন্ড্রেনের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলছেন, নির্যাতনের এই হার ২০১৭ এবং ২০১৮র তুলনায় অনেক বেড়েছে।

“বিগত বছরগুলোর তুলনায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। হত্যার ঘটনাও বেড়েছে।

তবে আগের চেয়ে তফাৎ হচ্ছে, আগে এ ধরণের নির্যাতনের শিকার বেশি হতো মেয়ে শিশুরা, এখন ছেলে শিশুরাও সহিংসতার শিকার হচ্ছে।”

তিনি বলছেন, মূলত তিনটি কারণে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে তারা জরিপে দেখতে পেয়েছেন।

“অধিকাংশ সময়ই পারিবারিক পূর্ব শত্রুতার কারণে শিশুরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। কিছুটা নিখোঁজ ছিল বা গুম হয়ে গেছে, পরে লাশ পাওয়া গেছে। এছাড়া পরকীয়ার জের ধরেও অনেক শিশু সহিংসতার শিকার হচ্ছে।”

এছাড়া সমাজের মধ্যে মানুষের যোগাোগও কমে যাওয়া এরএকটি কারণ বলে তিনি মনে করেন।

সহিংসতার ধরণে পরিবর্তন

বিগত কয়েক দশকে একটা সাধারণ ধারণা ছিল হয়তো শহুরে পরিবেশে শিশুদের নিরাপত্তা আগের চেয়ে কমে গেছে।

এজন্য বিভিন্ন সময় বিশ্লেষকেরা শহরে যৌথ পরিবারের বদলে একক পরিবার হওয়া, কর্মজীবী মায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এবং শিশুদের দেখাশোনার মানুষ না থাকা ইত্যাদি কারণকে দায়ী করেছেন।

ধারণা ছিল, গ্রামে তুলনামূলকভাবে হয়তো শিশুরা বেশি নিরাপদ।

কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সে ধারণাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।

এসব অপরাধ কেন ঠেকানো যাচ্ছে না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলছেন, অপরাধের বিচার না হওয়া একটি বড় কারণ।

“যেকোন ধরণের অপরাধের যদি বিচার না হয়, দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হয়, তাহলে সমাজে অপরাধ ঠেকানো যাবে না।

বাংলাদেশে এক সময় এসিড সন্ত্রাস হতো। কয়েকটি ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হবার পর সেটা অনেকটাই কমে গেছে।”

“এছাড়া অপরাধীদের প্রশ্রয় না দিয়ে সামাজিকভাবে যদি তাদের বয়কট করা যেতো, তাহলেও সমাজে থাকা অপরাধীরা সাবধান হয়ে যেতো।

সেটা আমাদের সমাজে এখন হয়না, অনেক সময়ই অপরাধীরা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে আশ্রয়প্রশ্রয় পায়, সেটা বন্ধ করতে হবে।”

অধ্যাপক আক্তার বলছেন, শিশুর নিরাপত্তায় পরিবার ও সমাজের সবার যেমন সচেতন হতে হবে, একই সঙ্গে রাষ্ট্রকেও সেই দায়িত্ব নিতে হবে।