বাংলাদেশে ব্যাংকের ঋণের সুদের হার কী কমবে?

বাংলাদেশে গত একবছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে চলেছে। সরকারি তাগিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা ছাড়ের পরেও এই অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি।

২০১৭ সালেও যেখানে ব্যাংকগুলো একক সংখ্যায়, অর্থাৎ ৯ শতাংশ হারে ঋণের সুদ গ্রহণ করতো, ২০১৮ সালের পর থেকে সেই হার এখন ব্যাংক ভেদে ১২ থেকে ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

যদিও গত বছরের মাঝামাঝিতে সরকারে-বেসরকারি বেশ কিছু ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছিল যে, পহেলা জুলাই থেকে তাদের আমানতের সর্বোচ্চ সুদের হার হবে ৬ শতাংশ। আর ঋণের সুদ হার হবে ৯ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ করেছে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক।

সোমবার একটি অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে গিয়ে এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ, অর্থ মন্ত্রণালয়, এমনকি সরকারের সর্বোচ্চ মহল এসব উষ্মার কোন প্রভাব পড়েনি সুদের হারের ওপর।

কেন কোন পরিবর্তন আসছে না?
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সুদের হার কমাতে পারছেন না, কারণ কম সুদে তারা কোন আমানত পাচ্ছেন না।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রেজা ইফতেখার বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”ব্যাংকিং তো একটা ব্যবসা। আমরা যে হারে আমানত পাই, সেটার জন্য পরিচালনা খরচ, লাভ যোগ করেই তো ঋণের সুদের হার ঠিক করবো। গত বছর আমরা ৬% হারে আমানত পেয়েছি, তাই ৯% হারে ঋণ দিতে পেরেছি। কিন্তু এখন তো আমাদের ১০% হারে আমানত নিতে নিচ্ছে। এমনকি সরকারি আমানতও কম সুদে নিতে পারছি না। তাহলে আমি কিভাবে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দেবো?”

তিনি বলেন, আমি তো আর লোকসান করে ঋণ দিতে পারবো না। যদি এটা আমাদের নিশ্চিত করা যায় যে, আমরা কম সুদে আমানত পাবো, সরকারি আমানতগুলো যদি আমাদের কাছে কম সুদে রাখা হয়, যদি অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এভাবে কম সুদে আমানত গ্রহণ করে তখন আমরাও ঋণের সুদের হার কমাতে পারবো।”

এজন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে বাজারে অর্থের তারল্য আরো বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, একটা সময়ে সরকার ব্যাংকের সুদের হার ঠিক করে দিতো (ক্যাপ পদ্ধতি-কম বেশি সুদের হার বেধে দেয়া), সেটা সবাই মেনে নিতে বাধ্য হতো। কিন্তু এখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার শুধুমাত্র কৃষি আর রপ্তানি ঋণের সুদের হারটি ঠিক করে দেয়, বাকি সব ঋণের সুদের হার ঠিক করে বাজার।

তিনি বলছেন, সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণের হার আনার কথা সরকার বলছে, কিন্তু যেহেতু এটা বাধ্যতামূলক নয়, তাই ব্যাংকগুলো সেটা মেনে চলার আগ্রহ দেখায় না। যেহেতু তাদের ব্যবসা করতে হবে, তাই তারা যে হারে আমানত পাবে, তার সঙ্গে পরিচালন খরচ আর মুনাফা যোগ করেই ঋণের সুদের হার ঠিক করে নেয়।

তিনি বলছেন, বাজারে ব্যাংক ছাড়াও অনেক নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহ করে। সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে আমানত নিচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রেই আমানতের সুদের হার বেশি, ফলে ব্যাংকগুলোকেও আমানত সংগ্রহ করার জন্য বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। ফলে তারা যখন এসব আমানত ঋণ হিসাবে দেবে, তখন তাদের ঋণের হারও বেড়ে যাচ্ছে।

র্তমানে বাজারে বাড়তি সুদের হারের জন্য তারল্য সংকট আর আমদানি বেড়ে যাওয়াকেও দায়ী করেন। তার দেয়া তথ্য মনে, গত বছর যেখানে আমদানি হয়েছিল ৪২ বিলিয়ন ডলার, এ বছর সেটি হয়েছে ৫৫ বিলিয়ন ডলার। সাত শতাংশ রপ্তানির বিপরীতে আমদানি হয়েছে ২৮ শতাংশ। ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে।

মুস্তফা কে মুজেরি বলছেন, সরকার যদি সত্যিই চায় যে, ব্যাংকিং সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে নিয়ে আসবে, তাহলে হয় সরকারি নির্দেশনা দিয়ে জোর করে বাস্তবায়ন করতে হবে অথবা সব ব্যাংক এবং নন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বলে আলোচনা করে আমানত আর ঋণের সুদের হার ঠিক করতে হবে। কেউ মানবে আর কেউ মানবে না, এভাবে এটা করা যাবে না। সবাইকে একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অথবা নির্দেশনা দিয়ে জোর করে বাস্তবায়ন করতে হবে।

কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছর কিছু ব্যাংক সরকারি ঘোষণার পর তাদের সুদের হার কমিয়েছিল। কিন্তু যখন দেখেছে যে, অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান সুদের হার কমাচ্ছে না, তখন আবার তারাও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, যেসব কারণে সুদের হার কমানো যাচ্ছে না

  • চড়া সুদে আমানত সংগ্রহ করতে বাধ্য হওয়া
  • সরকারি যথেষ্ট আমানত না পাওয়া
  • বাজারে ব্যাংকের বাইরে নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে আমানতে ও সরকারি সঞ্চয়পত্রে বেশি সুদ, ফলে আমানত কমে যাওয়া
  • কু-ঋণ বা ঋণ আদায় না হওয়া
  • বাজারে সব প্রতিষ্ঠান আমানতে সমান সুদ না দেয়া

বাংলাদেশ ব্যাংকের কি ভূমিকা রয়েছে?

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”মুক্তবাজার অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমানত-ঋণের সুদের হার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি কিছু করার ক্ষমতা সীমিত। যেহেতু ঋণের ক্যাপ পদ্ধতি এখন আর নেই, তাই বাজারের চাহিদার ওপরই এটি নির্ধারিত হবে।”

”তবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কিছু ব্যবস্থার মাধ্যমে তাতে কিছুটা প্রভাব রাখতে পারে। যেমন ব্যাংকের মোট আমানতের যে অংশটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়, সেখানে কিছুটা ছাড় দিলে তা ব্যাংকগুলোর তারল্য বাড়িয়ে দেয়। সেটা এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক করেছে, তাতে কিন্তু ঋণের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।”

তবে তিনি বলছেন, বাজারে তারল্য বাজারে ব্যাংকগুলোর কিছুটা সুবিধা হলেও, অন্যান্য ক্ষেত্রে তার অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সুতরাং শুধুমাত্র ঋণের সুদের হার কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে তারল্য বাড়িয়ে দেয়াও সম্ভব নয়।

তিনি বলছেন, এক্ষেত্রে মুদ্রাবাজারটিকে যদি প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা যায়, তাহলে কিছুটা লাভ হতে পারে।

সুদের হার কমানোর কী কোন উপায় আছে?
মুস্তফা কে মুজেরি বলছেন, বাজারে সক্রিয় ব্যাংক, নন-ব্যাংক সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সুদের হার কমানো যেতে পারে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় যদি কমানো যায়, তাদের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা যদি আরো বাড়ানো যায়, তাহলে তারা ঋণের সুদের হারও কমাতে পারবে। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে সরকারকে। কারণ এখন দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি, পরিচালন ব্যয় ইত্যাদি মিলে ব্যাংকের সুদের হার অনেক বেড়ে যাচ্ছে।

পাশাপাশি তিনি ব্যাংক এবং নন ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের পরামর্শ দেন।

তিনি বলছেন, একেকটা ব্যাংক একেকভাবে চলছে। পাশাপাশি নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে আরেকভাবে। কিন্তু তারাও আমানত নিচ্ছে, ঋণ দিচ্ছে। ফলে বাজারে একটি অসমতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ফলে পুরো খাতটি একটি সংস্কার দরকার, তাহলেই একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে। তার প্রভাব দেখা যাবে আমানত আর ঋণের সুদের হারেও।

দ্বিমুখী সংকট

ব্যাংকের ঋণের সুদের হার কমাতে হলে আমানতের সুদের হার কমাতে হবে। ফলে ঋণের সুদের হার কমালে যেমন ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন, কিন্তু আমানতের সুদের হার কমালে আবার সঞ্চয়কারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।

নুরুল আমিন বলছেন, ব্যাংকে সুদের হার যখন বেশি তখনো ব্যাংক ব্যবসা করেছে, আবার সুদের হার যখন কম তখনো ব্যবসা হয়েছে। বরং দেখা গেছে সুদের হার কম থাকার সময়ে ব্যাংকগুলোয় অনেক অর্থ অলস পড়েও ছিল।

কিন্তু সমস্যা হলো, ব্যাংকের আমানতের হার কমে গেলে তখন ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা নিরুৎসাহিত হয়ে বিকল্প বিনিয়োগের পথ খোঁজেন। ঝুঁকির কারণে তারা শেয়ারবাজারে বেশি যান না, তখন তারা সঞ্চয়পত্র, জমি ক্রয় ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করেন।

ফলে ব্যাংকগুলো বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ না পেলে তখন তাদের জন্যও আমানত সংগ্রহের সমস্যা তৈরি হতে পারে।