বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি সত্ত্বেও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন!

বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি শর্তেও নতুন আরো তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন দিতে যাচ্ছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতে অস্থিরতা দেখা দেয়ার পরও সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এ কারণে ব্যাংক খাতে অচিরেই বড় ধরনের ধস নামতে পারে। বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে দেশের অর্থনীতিরও।

শুধু সরকারের ইচ্ছাতেই অপ্রয়োজনে ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের আস্থা হারাচ্ছে। নতুন ব্যাংক না দেয়ার পক্ষে অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকররা বার বার পরামর্শ দিলেও তাতে কান দিচ্ছে না সরকার।’

‘যে হারে ব্যাংক হচ্ছে তাতে কয়দিন পর দেখা যাবে বীমার মতো যেখানে-সেখানে শুধু সাইনবোর্ড ঝুলছে। আর এ কারণে অচিরেই ধস নামতে পারে ব্যাংক খাতে। বড় ক্ষতি হতে পারে অর্থনীতিতেও।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। বিদ্যমান ৫৭টি ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে চতুর্থ প্রজন্মের ৯টি নতুন ব্যাংকের কার্যক্রম ভাল অবস্থায় নেই। ঋণ দেয়ায় অনিয়মসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে। এরপরও অনুমোদনের জন্য ৭০ থেকে ৮০টি নতুন ব্যাংকের আবেদন জমা পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিতে রাজী নয়। এর আগে ২০১২ সালে যে ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল সেগুলোতেও আপত্তি জানিয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। সর্বশেষ অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা ৩টি ব্যাংকের বিষয়েও সরাসরি নিষেধ করে তা অর্থমন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। এরপরও অনুমোদন দিতে যাচ্ছে সরকার।

গতকাল এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানিয়েছেন, নতুন ব্যাংকগুলোকে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। ‘বাংলা ব্যাংক’ নামে একটি ব্যাংক পাচ্ছে বেঙ্গল গ্রুপ। গ্রুপটির চেয়ারম্যান বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য মোরশেদ আলম। আর চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের ব্যবসায়ী ও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এমএ কাশেমকে দেয়া হচ্ছে ‘পিপলস ইসলামী ব্যাংক’। এছাড়া পুলিশকে দেয়া হচ্ছে আরো একটি ব্যাংক।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন উদ্ধর্তন কর্মকর্তা বলেন, নতুন কোনো ব্যাংক হোক, তা চায় না বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীকে ট্রাস্ট ও বিজিবিকে সীমান্ত ব্যাংক দেয়ার পর এবার পুলিশকে ব্যাংক দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান ও নৌবাহিনী আলাদা ব্যাংক চাচ্ছে। কিন্তু সব বাহিনীর কল্যাণার্থে আলাদা না দিয়ে বড় আকারে একটি ব্যাংক দিলেই ভালো হতো।

সম্প্রতি নতুন ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৯৫ শতাংশ ব্যাংকার মনে করেন, নতুন কোনও ব্যাংকের দরকার নেই। তাদের অনেকে বলছেন, না বাড়িয়ে বরং ব্যাংকের সংখ্যা কমানো উচিত।

প্রতিষ্ঠানটির অন্য এক জরিপে দেখা গেছে, নতুন চালু হওয়া ৯টি ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা সংকটে রেখে বেপরোয়াভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণের পরিমাণ।

এছাড়া নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১১ সালে করা জরিপে বলা হয়, বর্তমানে দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা বেশি রয়েছে।

সম্প্রতি পরিচালনা পর্ষদের সমস্যা থাকায় সম্প্রতি মেঘনা ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেছেন। বিভিন্ন অনিয়মের কারণে পদত্যাগ করতে হয়েছে ফার্মার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যাকেও। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অস্থিরতা চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, আগের ৯টি ব্যাংক অনুমোদনের সময়ও আমরা বলেছিলাম, নতুন ব্যাংক দিলে তারা পুরোনোগুলোর সাথে টিকতে না পেরে দুর্নীতির আশ্রয় নিবে এবং দুর্বল হয়ে পড়বে। এখন সেটাই প্রমাণ হচ্ছে। কারণ দুর্নীতির দায়ে ফার্মার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আরো দুইটি ব্যাংকের অবস্থা প্রায় ফার্মার্সের মতোই খারাপ। অন্যগুলোর অবস্থাও খুব বেশি ভাল শোনা যায় না। সেগুলো বিস্তৃত হতে পারছে না। এ অবস্থায় আরো নতুন ব্যাংকের কি যৌক্তিকতা আছে তা জানা নাই।

তিনি আরও বলেন, দেশে নতুন কোনো ব্যাংকের দরকার হলে বাংলাদেশ ব্যাংকই সরকারকে জানাবে। কিন্তু এখন উল্টো সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নতুন ব্যাংকের জন্য সুপারিশ করছে। কেন এ রকম হচ্ছে তা বুঝে আসছে না।

নতুন ব্যাংক না দিয়ে পুরোনাগুলোকে একীভূত করা দরকার মনে করে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, সরকারের উদ্যোগে বিনিয়োগকারীদের দিয়ে ঝিমিয়ে বা সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে চাঙ্গা করলে এখাতে অস্থিরতা কমবে।

সর্বশেষ চালু হওয়া ৯টি ব্যাংক সম্পর্কে আবু আহমেদ বলেন, সরকারের চাপ থাকলেও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া উচিত হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের। কারণ এটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তারা যদি আর্থিক খাতের এ বিষয়ে শক্ত নজর না দেয় তাহলে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে তো কোনো পার্থক্য থাকলো না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অস্থিরতা দেখা দেয়ার পরও নতুন করে আরো তিনটি ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘অস্থিরতা তো দেখছি না। কারো মালিক হওয়ার ইচ্ছা থাকলে নতুন ব্যাংকের জন্য অনুমোদন তো চাইবেই।’-চ্যানেল আই অনলাইনের সৌজন্যে