বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা আরসিবিসির

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় নাম জড়ানোয় ‘মানহানির’ অভিযোগে এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেছে ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন-আরসিবিসি।

হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারের আশায় গত ২ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে আরসিবিসির বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কৌঁসুলি আজমালুল হোসেন কিউসি চলতি মাসের শুরুতে বলেন, মামলা করলেও এবার তারা বিবাদীদের সঙ্গে সমঝোতা করে অর্থ ফেরত পাওয়ার চেষ্টা চালাবেন।

মঙ্গলবার আরসিবিসির পাল্টা এই মামলা করার খবর দিল বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

ফিলিপিন্সের এ ব্যাংক জানিয়েছে, তাদের কোম্পানির সুনাম ও ভাবমূর্তির ওপর বার বার ‘অশুভ আক্রমণ’ চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ কোটি পেসো (১৯ লাখ ডলার) দাবি করা হয়েছে মামলায়।

গত ১ ফেব্রুয়ারি তিন বছর আগে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্য ফিলিপিন্সের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নিউইয়র্কের ম্যানহাটন সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে দায়ের করা এ মামলায় রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (আরসিবিসি) এবং ওই ব্যাংকের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ডজনখানেক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে অভিযোগ বলা হয়, কয়েক বছর ধরে ‘জটিল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে’ আসামিরা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (ফেড) রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়।

এর মধ্যে একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় একটি ‘ভুয়া’ এনজিওর নামে ২০ মিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।

বাকি চারটি মেসেজের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরিয়ে নেয়া হয় ফিলিপিন্সের মাকাতি শহরে রিজল কমার্সিয়াল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায় ‘ভুয়া তথ্য’ দিয়ে খোলা চারটি অ্যাকাউন্টে।

অল্প সময়ের মধ্যে ওই অর্থ ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া হয়, ফিলরেম মানি রেমিটেন্স কোম্পানির মাধ্যমে স্থানীয় মুদ্রা পেসোর আকারে সেই অর্থ চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোর কাছে।

এরমধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দেয়া হলেও বাকি অর্থ উদ্ধারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, রিজার্ভের অর্থ চুরির কাজে ‘অজ্ঞাতনামা উত্তর কোরীয় হ্যাকারদের’ সহায়তা নেয় আসামিরা। ‘নেস্টেগ’ ও ‘ম্যাকট্রাক’ এর মত ম্যালওয়্যার পাঠিয়ে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট নেটওয়ার্কে ঢোকার জন্য পথ বের করে। পরে নিউইয়র্ক ফেড থেকে টাকা সরিয়ে নেয়া হয় নিউইয়র্ক ও ফিলিপিন্সে আরসিবিসির অ্যাকাউন্টে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ওই অ্যাকাউন্টগুলোর ওপর আরসিবিসি এবং এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। কী ধরনের অপরাধ হচ্ছে জেনেও অ্যাকাউন্ট খোলা, বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর এবং পরে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়ার বিষয়গুলো ঘটতে দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির সাংবাদিকদের বলেন, রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা এ মামলার উদ্দেশ্য।

ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক মামলা পরিচালনায় সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

মামলা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল কয়েক দিন আগে নিউ ইয়র্কে যান। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ, একই ইউনিটের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুর রব এবং অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক জাকির হোসেন রয়েছেন ওই দলে।

নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বনাম রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন’ মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছে ১৯-০০৯৮৩ নম্বরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে এ মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ল ফার্ম কোজেন ও’কনর।

মামলার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আরসিবিসির কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ল ফার্ম কুইন ইমানুয়েলকে ইতোমধ্যে এ মামলা লড়ার দায়িত্ব দিয়েছে তারা। শুক্রবার ম্যানিলা স্টক এক্সচেঞ্জকে বিষয়টি জানানোও হয়েছে।

এ মামলার দায়িত্ব পাওয়া কুইন ইমানুয়েলের আইনজীবী তাই-হেং চেং বলেন, এ মামলা যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি ছাড়া আর কিছু নয়, সেটা আমরা আদালতে দেখিয়ে দেব। তারা নিজেদের দায় আরসিবিসির ঘাড়ে চাপাতে চায়।

ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ এই সাইবার জালিয়াতির ঘটনা জানাজানি হলে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের মানুষ বিষয়টি জানতে পারে ঘটনার এক মাস পর ফিলিপিন্সের একটি পত্রিকার মাধ্যমে।

বিষয়টি চেপে রাখায় সমালোচনার মুখে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন আতিউর রহমান; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে আনা হয় বড় ধরনের রদবদল।

বাংলাদেশের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপিন্সে ঢোকার বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে দেশটির সিনেট কমিটি তদন্ত শুরু করে। ওই ঘটনায় সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার পর আরসিবিসি তাদের শাখা ম্যানেজর দেগিতোকে বরখাস্ত করে।

আর ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা পাচার ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় ১ কোটি ৯১ লাখ ডলার জরিমানা করে আরসিবিসিকে।

ওই সময় করা মামলায় ফিলিপিন্সের আদালত গত ১০ জানুয়ারি আরসিবিসির শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগিতোকে মুদ্রাপাচারের আট দফা অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের করা মামলাতেও তাকে আসামি করা হয়েছে।

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশেও একটি মামলা করা হয়।

২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা মতিঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করেন।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা ওই মামলায় সরাসরি কাউকে আসামি করা হয়নি। তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ গত তিন বছরেও আদালতে প্রতিবেদন দিতে পারেনি।