বাংলা ভাষায় নৈরাজ্য || সাফাত জামিল শুভ

প্রত্যেক মানুষই যেমন তার মাকে ভালোবাসে তেমনি মায়ের ভাষাকেও ভালোবাসে। মায়ের ভাষায় কথা বলার মতো স্বাচ্ছন্দ্য, আবেগ অন্য কোনো ভাষাতেই তা সম্ভবপর নয়। মাতৃভাষা প্রতিটি মানুষের অন্তরের ভাষা। অন্য কোনো ভাষাতেই তা ব্যক্ত করা যায় না। কবির ভাষায়-

‘বিনে স্বদেশী ভাষা
মিটে কি আশা?’

আমরা যদি জাপান, চীন এবং জার্মানির দিকে দৃষ্টি দেই, তাহলে দেখতে পাব যে, তারা তাদের সমস্ত কাজে মাতৃভাষাকেই ব্যবহার করছে। তবে বিশেষ কোন প্রয়োজনে ইংরেজি ব্যবহার করছে, তবে তা যৎসামান্য। আবার যদি ফ্রান্স এবং সুইডেনের দিকে তাকালে দেখা যায় তারা সমস্ত কাজ তাদের মাতৃভাষাতেই করে। তারা ইংরেজি চর্চা করে না। তাদের দেশের সিংহভাগ লোকই ইংরেজি জানে না এবং বোঝে না। তাদের দেশে ইংরেজির কোন প্রচলন নেই। নেই কোন ইংরেজি সংবাদপত্র। টিভিতেও ইংরেজি সংবাদপত্র পাঠ হয় না।

অথচ ফ্রান্স এবং সুইডেন উন্নত দুটি রাষ্ট্র। যদি ফ্রান্স এবং সুইডেন ইংরেজি না জেনে নিজেদেরকে সমৃদ্ধশালী করতে পারে, উন্নতির শেখরে পৌছতে পারে তাহলে আমরা পারব না কেন? এটা কি আমাদের নিতান্তই ইংরেজির ব্যর্থতা? না কি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যর্থতা? ভারতের প্রথম বাঙালি রাস্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী কিছুদিন আগে এ প্রসঙ্গেই বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণ তো দূরেই থাক বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষার স্বকীয় অস্তিত্ব নিয়েই দেখা দদিয়েছে সন্দেহ। বাংলা ভাষার ব্যবহার ও লেখার ক্ষেত্রে এক ধরনের বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য চলছে সর্বত্র। ভাষা ও ব্যাকরণের বিধি-বিধান আমরা যথাযথভাবে অনুসরণ করছিনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বাংলাভাষা শুদ্ধভাবে লিখতে ও শুদ্ধ উচ্চারণে প্রণোদনার অভাব রয়েছে শিক্ষকদের।

ভাষার পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, ভাষা ও সংস্কৃতি একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই বাংলার মতো একটি ভাষার উন্নয়নে এবং রক্ষণাবেক্ষণে যদি ভাষানীতি না থাকে, তাহলে প্রতিবেশী সংস্কৃতি ও ভাষার আগ্রাসনে বাংলা ভাষার বিলুপ্তি ঘটা অবাস্তব কোনও বিষয় নয়।

আমাদের কিশোর তরুণদের মধ্যে বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি-উর্দু মিশিয়ে কথা বলার অশুভ প্রবণতা দৃশ্যমান। অন্যকথায় বলা যেতে পারে, দ্বিভাষিক- ত্রি-ভাষিক প্রবণতা বাড়ছে আমাদের শিশু-কিশোরদের মাঝে। দ্বিতীয়ত, আমাদের গণমাধ্যমে ভাষার বিকৃতি সাধন চলছে; এফএম রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমায়, বিদেশি ভাষার শব্দের সাথে নানা আঞ্চলিক ও কথ্যভষার সংমিশ্রণে, অদ্ভুত উচ্চারণে বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, এটি বাংলাভাষাকে দুর্বল করছে, ভাষার শক্তিমত্তা ক্ষুণ্ন করছে।

আমরা ভুলে যেতে বসেছি, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি বাঁকে রয়েছে নির্মল রক্ত কণিকার মণিমুক্তা। দীর্ঘ রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়েই বাঙালি জাতি তার অস্তিত্বের ইতিহাস রচনা করেছে। ভাষা আন্দোলন এই ইতিহাসের একটি আলোকোজ্জ্বল অধ্যায়। পৃথিবীরকোন জাতি তার নিজের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি; বিলিয়ে দেয়নি অকাতরে জীবন। এ কারণে বাঙালির এ মহান আত্মত্যাগ গোটা বিশ্ব স্মরণ করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে।ভাষা আন্দোলনের হাত ধরেই আমরা অর্জন করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

আজকের তরুণসমাজের এক বড়ো অংশ মাতৃভাষা চর্চা ও এর সর্বাঙ্গীণ ব্যবহারে উদাসীন, নির্লিপ্ত। ভাষার বিকৃতিসাধন ভাষাকে দুর্বল, হীন করে দিতে যথেষ্ট। আমাদের মাতৃভাষার বিকৃতি, রূপান্তর, অপব্যবহার, হচ্ছে নানাভাবে। তার ওপর আছে বিদেশি ভাষার আগ্রাসন।অবাধে বিদেশি ভাষা বিশেষ করে ইংরেজির ঢালাও অনুপ্রবেশ ঘটছে বাংলা ভাষায়, সেই সাথে আরবি-ফার্সি-উর্দু-হিন্দি শব্দ ঢুকে যাচ্ছে অভিবাসন ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে। এর ফলে জগাখিচুড়ি ভাষার উদ্ভব হচ্ছে যা বাংলাভাষার বিকৃতি ঘটাচ্ছে।

একসময় উর্দু ভাষার সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে সাফল্যের সঙ্গে রুখে দিতে পারলেও আমরা হিন্দি ভাষার আধিপত্যবাদী আগ্রাসনকে রুখে দিতে পারছি না। বিশ্বায়নের অনুকূল স্রোত এখন এই নতুন ভাষা সাম্রাজ্যবাদের সহায়। ফিল্ম, টেলিভিশন, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অবাধ প্রযুক্তি বিজ্ঞানের সুযোগে এবং উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের শাসকদের ভাষা হওয়ার ফলে এই ভাষা এখন প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোর ন্যাশনাল বেরিয়ার বা জাতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে অদৃশ্য জীবাণুর মতো আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি, এমনকি প্রাত্যহিক জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করছে। এটা সংস্কৃতির মেলবন্ধন নয়, এটা স্পষ্টভাবে একটি আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসন।

প্রভাতফেরির গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীর মত আক্ষেপের সুরেই বলব- “আমরা হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সমমর্যাদাভিত্তিক সম্প্রীতি চাই। কিন্তু তার আধিপত্যবাদী যে আগ্রাসী চেহারাটি উপমহাদেশে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তাকে খুব ভয় পাই।”

লেখক : সাফাত জামিল শুভ, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়