বাড্ডায় নিত্য যানজট, বনশ্রীর ভাঙা সড়ক ধুলার রাজ্য

রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের অন্যতম মালিবাগ-রামপুরা-বাড্ডা-প্রগতি সরণি-কুড়িল সড়ক চরম ভোগান্তির যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। রামপুরা-ডেমরা সংযোগ সড়ক ও মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভার চালু হওয়ার পর এই পথে চলাচল করা যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।

অথচ উন্নয়নকাজ চলায় যান চলাচলের পথ হয়েছে আরো সংকুচিত। বিগত বর্ষায় এই পথে চলতে গিয়ে খানাখন্দে ঘটেছে নানা দুর্ঘটনা। চলতি শুষ্ক মৌসুমে ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠেছে ধুলা। যানজটে আটকে থাকা যাত্রীরা এই পথে চলতে গিয়ে ধুলার সমুদ্রে গোসল করার মতো অবস্থা। বিশেষত রামপুরা ব্রিজ থেকে পূর্বদিকে বনশ্রী আবাসিক এলাকায় খানাখন্দের সড়কে চলতে গিয়ে কোমর ভাঙার শঙ্কায় থাকেন যাত্রীরা। ধুলার অত্যাচার তো আছেই।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অধীন রামপুরা-কুড়িল সড়কের বিভিন্ন অংশে এক বছর ধরে উন্নয়নকাজ চললেও দুর্ভোগ থেকে রেহাই মিলছে না। রাজউকের হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন যানজট নিরসনের জন্য মেরুল বাড্ডায় চলমান ইউলুপ নির্মাণকাজ ৮২ শতাংশ এগিয়েছে। কাজ সময়মতো শেষ হয়নি বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন সরানোর কাজে বিলম্ব হওয়ায়।

রামপুরা-কুড়িল সড়কে চলতে গিয়ে বড় আতঙ্ক মেরুল বাড্ডায় ইউলুপ নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এলাকা। উন্নয়ন কাজের জন্য এখানে সড়ক প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। তার ওপর পিচহীন রাস্তায় বড় বড় গর্তের কারণে বাসে চলাও দায়। নিত্য লেগে থাকে যানজট। বনশ্রী থেকে ইউলুপ প্রকল্প এলাকা হয়ে বাড্ডা লিংক রোডের দিকে আসতে গিয়ে গতকাল দুপুর সোয়া ২টার দিকেও পড়তে হয় তীব্র যানজটে। দিনের অন্য সময় বিশেষত সকালে অফিস শুরু ও বিকেলে অফিস ছুটির পর প্রতিদিন এখানে যানজট লেগে থাকে। লিংক রোড হয়ে গুলশান অভিমুখী যানবাহন রোড ক্রসিংয়ে ঘোরানোর কারণে এখানে যানজট আরো তীব্র হয়ে থাকে।

তবে রামপুরা থেকে আসার পথে যানজট তুলনামূলক কম থাকলেও কুড়িল থেকে রামপুরা অভিমুখী যানবাহনগুলো এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়ে থাকছে। কারণ সড়ক বিভাজকের পূর্বাংশের অবস্থা ভয়াবহ। হোসেন মার্কেটের সামনে থেকে শুরু করে ইউলুপ প্রকল্প এলাকার দক্ষিণাংশ পর্যন্ত পুরো সড়ক খানাখন্দে ভরা।

কুড়িল-রামপুরা রোডের বাড্ডা অংশ গতকাল সন্ধ্যার দিকেও যথারীতি যানজটে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। মেরুল বাড্ডায় নির্মাণাধীন ইউলুপ প্রকল্প অংশে রাস্তার দুই পাশ যানজটে স্থবির। আটকা পড়ে আছে সুপ্রভাত, তুরাগ, ফাল্গুন, রাইদা, নূর এ মক্কা পরিবহনসহ বিভিন্ন পরিবহন কম্পানির যাত্রীবাহী বাস। চারপাশ ধুলায় ধূসর।

এই পথে চলতে গিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী নবারুন দে বললেন, ‘কালো রঙের কোটটা সাদা হয়ে গেল। ’ চোখে-মুখে ধুলো মেখে সামনে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব রিকশাচালক আলী হোসেন বললেন, ‘রাইতে আরো বেশি জ্যাম লাগে। বিশেষ কইরা উত্তর বাড্ডায় বাজারের কাছে জ্যাম আর ছাড়ার নাম নেয় না। ’

এই রুটের নিয়মিত যাত্রী ও গাড়িচালকরা জানান, মেরুল বাড্ডা থেকে লিংক রোড পর্যন্ত অংশে যানজটে পড়তেই হয়। গত সোমবার বড়দিন উপলক্ষে ছুটি থাকলেও সড়কের এই অংশে ঠিকই যানজটে পড়তে হয়। এই পথে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রী সুজান হক কালের কণ্ঠকে বলেন, সকালে কোনো কোনো দিন বাড্ডা লিংক রোড থেকে মেরুল বাড্ডায় যেতেই দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়।

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা জানান, মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার চালুর পর এই সড়কে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে। তবে মালিবাগ, মৌচাক ও মগবাজার হয়ে বেশির ভাগ গাড়ি এখনো ফ্লাইওভারের নিচ দিয়েই চলাচল করছে বেশি যাত্রী তোলার জন্য। ফলে মালিবাগ ও মৌচাকের যানজটের চিরচেনা চিত্র এখনো রয়ে গেছে।

সরেজমিনে গতকাল বাড্ডা অংশে প্রগতি সরণির রাস্তায় দেখা গেছে, নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে সড়কের পাশে। উন্নয়নকাজের জন্য তুলে আনা মাটি রাস্তায় শুকিয়ে তা থেকে ধুলার ঝড় উঠছে অবিরত। জানা গেল, ইউলুপের নির্মাণকাজের জন্য আগে থেকেই সড়কটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ওপরে ইউলুপের চলাচলের পথ বা র‌্যাম্প নির্মাণ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ শেষ না হওয়ায় নিচে চলাচলের পথ আগের মতো প্রশস্ত রাখতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। ফলে যানজটও পিছু ছাড়ছে না।

জানা যায়, হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মেরুল বাড্ডায় যান চলাচলের জন্য ইউলুপ নির্মাণ শুরু হয় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের অধীন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৭ প্রকৌশল নির্মাণ ব্যাটালিয়ন। নির্মাণকাজ করছে স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। ইউলুপটি দৈর্ঘ্যে ৪৫০ ও প্রস্থে ১০ মিটার।

ডিএনসিসির ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র ওসমান গনি বলেন, ‘হাতিরঝিল প্রকল্পের আওতায় ইউলুপটি করা হচ্ছে। মেরুল বাড্ডার এই নতুন ইউলুপ চালু হলে রামপুরা, বনশ্রী বা আফতাবনগরে চলাচলের জন্য গাড়ির চালকরা অনায়াসে লেন পরিবর্তন করতে পারবেন। ’

হাতিরঝিল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প কর্মকর্তা (রাজউক অংশ) জামাল আক্তার ভুঁইয়া গতকাল বলেন, ‘আগামী জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ আছে। আমরা আরো এক বছর সময় চেয়েছি। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন সরাতে গিয়ে বিলম্ব হয়েছে। এই ইউলুপ চালু হলে যানজট কমবে। ’ তিনি বলেন, গাড়ির চলাচল বেড়ে যাওয়ায় এ পথে এসি ট্রাফিকের অফিসও করা হয়েছে বিটিভি ভবনের কাছে।

চালকরা জানান, উত্তরার রানীগঞ্জ থেকে কুড়িল ও মেরুল বাড্ডা হয়ে সদরঘাট পথের দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। রানীগঞ্জ থেকে নতুনবাজার ১১ কিলোমিটার চলতে লাগে ৪০ মিনিট। আর নতুন বাজার থেকে মেরুল বাড্ডা পর্যন্ত এক কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতেও লেগে যাচ্ছে একই পরিমাণ সময়।

রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জ, আশুলিয়া, টঙ্গী ও গাজীপুরে চলাচলের জন্য মেরুল বাড্ডা হয়ে বাস, মিনিবাস ও অন্যান্য যানবাহনকে চলাচল করতে হয় যানজটে কর্মঘণ্টা খুইয়ে। গতকাল দুপুরে সুপ্রভাত পরিবহনের যাত্রী গাজীপুরা যাওয়ার জন্য রামপুরা ব্রিজে বাসে উঠেই দেখেন সামনে সারি সারি যানবাহন আটকে আছে। হাতিরঝিল প্রকল্পের অধীন নির্মিত সড়ক, ডেমরা থেকে বনশ্রী-রামপুরা হয়ে ছোট ছোট যানবাহন একই সড়কে জট পাকিয়েছে। রামপুরা ব্রিজের পাশে বনশ্রী হয়ে চিটাগাং রোডের যাত্রী তুলতে থাকা টেম্পোচালক সুরত আলী বলেন, রামপুরার মূল সড়কে ভয়ে গাড়ি চালাই না। বাড়তি যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে বনশ্রী আবাসিক এলাকার সড়ক।

গাবতলী থেকে সায়েদাবাদ ১৪৯ নম্বর রুটের বাস চলাচল করে এই পথে। গাবতলী, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা ও বাসাবো হয়ে চলাচল করে লোকাল বাস। এ রুটের দূরত্ব প্রায় ২৬ কিলোমিটার। এই রুটের বাসচালক রুমন মিয়া বলেন, ‘ছুটির দিনে কোথাও জ্যাম না থাকলেও মেরুল বাড্ডায় তা থাকে। আটকে পড়লে মেরুল বাড্ডাতেই আধাঘণ্টা বা এক ঘণ্টা শেষ। ’

মেরুল বাড্ডা ছাড়াও রামপুরা ব্রিজ থেকে পূর্বদিকে চলে যাওয়া বনশ্রী-ডেমরা সড়কের অবস্থাও শোচনীয়। সড়কজুড়ে গভীর গর্ত আর খানাখন্দ। বনশ্রী আবাসিক এলাকার ডি-ব্লকের বাসিন্দা সাদিকুল ইসলাম সাদিক বলেন, ‘প্রাইভেট কারের ভেতরে বসে ধুলোবালি থেকে রক্ষা মেলে। কিন্তু বীভৎস রাস্তায় চলতে গিয়ে একেক সময় মনে হয় কোমরটাই বুঝি ভেঙে গেল। ’ রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রী আবাসিক এলাকার সি-ব্লকের দিকে গতকাল দুপুরে যেতে চাইছিলেন নবী হোসেন। ধুলায় পোশাকের রং বদলে যাবে বুঝতে পেরে তিনি রামপুরা বাজারের দিকে এগিয়ে গিয়ে বিকল্প রাস্তা ধরেন।