বাতিল মোবাইল ফোন থেকে বাঁচার উপায় কি?

বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার চলছে গত দুই যুগ ধরে। প্রতিবছর যেমন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি ক্রেতাদের হাতে আসছে নিত্যনতুন মোবাইল সেট। কিন্তু সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পুরনো, বাতিল বা নষ্ট হয়ে যাওয়া মোবাইল সেটের সংখ্যাও।

তবে বাতিল হওয়া এসব ফোনসেট হতে পারে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ।

বাতিল ফোনের গতি কী হয়?

বাংলাদেশে এখন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তের কোটি। আর প্রতিবছর প্রায় তিন কোটি মোবাইল ফোন আমদানি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে বাতিল ফোনের সংখ্যাও। কিন্তু এসব ফোনের গতি কী হয়? জিজ্ঞেস করেছিলাম ঢাকার কয়েকজন বাসিন্দাকে।

একজন বলছিলেন, তিনি তার পুরনো ফোনটি যে কোথায় রেখেছেন, আর মনে নেই।

আরেকজন জানালেন, ফোনটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ছেলেকে সেটা খেলনা হিসাবে দিয়েছেন।

একজন বলছেন, নতুন ফোন কেনার পর ফোনটি কিছুদিন ড্রয়ারে ছিল। ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ফেলে দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একেকটি ফোনের আয়ু বিবেচনা করা হয় গড়ে দুইবছর। কম দামি ফোনগুলোর আয়ু আরো কম।

ই-বর্জ্য নিয়ে গবেষণার পর, এসডো নামের একটি বেসরকারি সংস্থার টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার শাহরিয়ার হোসেইন বলছেন, বছরে যদি তিন কোটি ফোন আমদানি হয়, তাহলে ধরেও নিতে হবে, একই পরিমাণ ফোন বাতিলও হয়ে যাচ্ছে। আর এসব বাতিল ফোন পরিবেশের জন্য তৈরি করছে মারাত্মক ঝুঁকির।

শাহরিয়ার হোসেইন বলছেন, ”দুই তিন বছর আগে মোবাইল ফোন থেকে যে পরিমাণ ই-বর্জ্য তৈরি হতো, এখন কিন্তু সেটা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমাদের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর বিশ লাখ মেট্রিকটন ই-বর্জ্য তৈরি হয়। তার ২৫ থেকে ৩০ ভাগই হচ্ছে মোবাইল ফোন থেকে।”

কিন্তু এটা পরিবেশের জন্য বা মানব স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর?

মি. হোসেইন বলছেন, ”এসব পরিত্যক্ত ফোন যদি পরিবেশের সাথে মেশে, নানাভাবে সেটা যেমন পরিবেশকে দুষিত করে, তেমনি ফুড চেইনের মাধ্যমে সেটি আবার মানব দেহেও ফিরে আসে। একেকটি সেটে বিভিন্ন ধরণের হেভি মেটাল থাকে। সীসা রয়েছে, মার্কারি রয়েছে, ক্যাডমিয়াম রয়েছে, ক্রোমিয়াম থাকে, আর্সেনিক থাকে। এগুলো কোনভাবেই যদি মানবদেহে প্রবেশ করে, সেটি স্বাস্থ্যের হানি ঘটায়। অবশ্যই এটা নানাভাবে শারীরিক ক্ষতির কারণ হবে। ”

তিনি বলছেন,” উন্নত দেশগুলোতে এরকম বাতিল মোবাইল ফোন সেট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানই পুনরায় কিনে নিতে বাধ্য থাকে। অনেক সময় নতুন সেট কেনার সময় পুরনোটি ফিরিয়ে দিলে, কিছু টাকা ছাড় পাওয়া যায়। বাংলাদেশেও এরকম একটি ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাহলেই মোবাইল ফোন সেটের ই-বর্জ্য কমে আসবে। এজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং ফোন বিক্রেতাদের বাধ্য করতে হবে। ”

বাতিল এবং নষ্ট এসব ফোন সংগ্রহে সম্প্রতি একটি উদ্যোগ নিয়েছে দেশের বড় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণ ফোন।

তাদের গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে একটি বাক্স রাখা হয়েছে, যেখানে যেকেউ তার বাতিল ফোনটি দিতে পারবেন। যা পরে নিয়ম মেনে পুন:প্রক্রিয়াজাত করা হবে।

প্রতিষ্ঠানটির চীফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মাহমুদ হোসেইনের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা সাড়া কেমন পাচ্ছেন?

মাহমুদ হোসেইন বলছেন, ”আমরা দেখতে পেয়েছি যে, বিপুল পরিমাণ মোবাইল ফোন সেট অব্যবহৃত বা নষ্ট হয়ে থাকছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এই ক্ষতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য এখানে তেমন কোন উদ্যোগ নেই। আমরা যেহেতু এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছি, তাই আমরা একটা তাগিদ অনুভব করেছি যে, এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এগিয়ে আসা দরকার। কিন্তু আমরা মনে করি, শুধু আমরা একা পারবো না, বরং সব নাগরিককে বুঝতে হবে, এটি তাদেরও নাগরিক দায়িত্ব। ”

তিনি বলছেন, ”খুব বেশি সাড়া পেয়েছি এটা বলবো না। কয়টি সেট জমা পড়লো না পড়লো, তা নয়, কিন্তু এটা আসলে একটি সচেতনতা বাড়ানোর একটি চেষ্টা। প্রতিবছর তিন কোটি ফোন সেট আমদানি হয়। আসলে আমার ধারণা ২০/২৫ কোটি ফোন সেট হয়তো অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। মানুষ যদি বুঝতে পারে যে, তাদের এসব অব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেট পরিবেশের ক্ষতি করছে, তার ক্ষতির কারণ হচ্ছে, সেই সচেতনতা তৈরির এটি একটি প্রক্রিয়া শুরু বলা যেতে পারে।”

এ জন্য তেমন একটা বাড়তি খরচ করতে হয় না বলেও তিনি জানান।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে মোবাইল ফোন বিক্রি হলেও, ক্রেতা বা বিক্রেতা, কারো মধ্যেই এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ ফোনের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়নি।

যেসব প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফোন বিক্রি করেন, তারাও তাদের বাতিল ফোনের দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। পরিবেশকর্মীদের দাবি, একটি নীতিমালাই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে, যার ফলে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানই গ্রাহকদের নষ্ট ফোনগুলো ফেরত নিতে বাধ্য হবে।

টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিষয়টি নিয়ে তারা কি ভাবছেন?

বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলছেন, ”একটি ফোনের ব্যবহার শেষ হয়ে গেলে, সেটি যেন যেখানে সেখানে না ফেলে সবাই একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে সেই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। পাশাপাশি পুরনো ফোনটি ফেরত দেয়া হলে সে যেন একটি মূল্য ফেরত পায়, সেটিও করতে হবে। যদিও এখনো কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করার বিষয়ে আমরা অবশ্যই ভাবছি। কিন্তু শুধু বিটিআরসি এটি করলেই হবে না, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ কয়েকটি সংগঠন বা সংস্থাকে নিয়েই, যাদের এই বিষয়ে ধারণা রয়েছে, তাদেরও এই নীতিমালা প্রণয়নে জড়িত করতে হবে। ”

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোবাইল ফোনের আমদানি এবং বিক্রি যতটা বাড়ছে, ততটাই বাড়ছে বাতিল ফোনের সংখ্যাও।

ফলে এখনি এসব ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেয়া না হলে, ভবিষ্যতে বড় ধরণের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা থেকেই যাচ্ছে।-বিবিসি