বিকল্প ভাবছে সরকার

ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে। এ জন্য প্রস্তুত হচ্ছে সরকার। সেই সঙ্গে এ রায় নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিকল্প পথগুলো নিয়ে বেশি ভাবছেন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা। সমঝোতার পথ ধরে সমাধানের চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যেতে পারে, এমন আশঙ্কায় বিকল্প পথগুলো এখন গুরুত্ব পেয়েছে সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহলে।

বিকল্পগুলোর মধ্যে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ ও প্রধান বিচারপতির শপথ ভঙ্গের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে গুরুত্বের সঙ্গে। আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক নীতি-নির্ধারক এমন তথ্য জানিয়েছেন। তবে বিকল্প পথ অনুসরণ করার আগে এর বিরূপ প্রভাব কী হতে পারে, সে সম্পর্কেও নিশ্চিত হতে চান তারা। এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এরই অংশ হিসেবে গত বুধবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বৈঠক করেছেন। সূত্রমতে, ষোড়শ সংশোধনী রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিরসনে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে ওই বৈঠকে।

জানা গেছে, ষোড়শ সংশোধনীর রায় ছাড়াও অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির বিধিমালা সংক্রান্ত আইন ও নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা কেড়ে নেয়াকে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব প্রধান বিচারপতির ওপর সরকারের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে চরম বিবাদে জড়িয়েছে সরকার ও বিচার বিভাগের শীর্ষ পর্যায়। এসব কারণে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে বিকল্প ভাবনাই নীতি নির্ধারকদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। তবে বিকল্প ভাবনার বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়লেও এ ক্ষেত্রে আরও সময় নেবে সরকার। এর জন্যে আরও গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করবে সরকার।

সূত্র জানায়, শুধু যে ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা-ই নয়, দূরত্ব সৃষ্টির আরও কারণ হলো নিু আদালতের বিচারকদের চাকরির বিধিমালা সংক্রান্ত আইন ও নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বাতিল করা নিয়ে।

জানা গেছে, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে প্রধান বিচারপতি যেসব পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, অথবা সম্প্রতি যেসব বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন, তাতে স্বীয় পদে থেকে বিচারপতি তার শপথ ভঙ্গ করেছেন কিনা, সে বিষয়ে রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বুধবারের বৈঠকে।

জানা গেছে, প্রধান বিচারপতির শপথ ভঙ্গ হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে আওয়ামী লীগের আইনজীবীরাও। ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, তা নিরসনে রাষ্ট্রপতি সমাধান দিতে পারেন কিনা, তা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে ওই বৈঠকে।

সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৭ নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তবে এসব পদ্ধতি অনুসরণ করার প্রয়োজন পড়লে সেক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া কী হয়, তা নিয়ে এখন ভাবা হচ্ছে। এসব পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে পরবর্তী পরিস্থিতি আরও বেশি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে কিনা, তা বুঝে ওঠার চেষ্টা চলছে সরকারের ভেতরে।

ক্ষমতাসীন দলের সূত্রমতে, গত মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) পর্যন্ত ইস্যুটি নিয়ে সমঝোতার আশা করলেও বুধবার (১৬ আগস্ট) সে আশায় চিড় ধরে বলেই উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করা হয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একজন নীতি-নির্ধারক বলেন, ‘ইস্যুটি নিয়ে সমঝোতার পথ অনেকখানি রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে বিষয়টি মীমাংসার জন্যে সরকারের হাতে যে পদ্ধতি রয়েছে, তা অনুসরণ করলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।’ তিনি নিশ্চিত করেন সমঝোতার সম্ভাবনা একেবারেই কম।

সরকারের দু’জন নীতি-নির্ধারক বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে মূলত সমঝোতায় কীভাবে আসা যায়, তা খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে সেটা ভেস্তে গেছে। তাই বিকল্প পদ্ধতিগুলো নিয়ে পর্যালোচনা শুরু হয়েছে দল ও সরকারের ভেতরে।’ ওই দুই নেতা বলেন, ‘সর্বশেষ দলীয় ফোরামের একটি সভায় সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পরিস্থিতি জটিল অবস্থায় গেলে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।’ মনে হচ্ছে এখন সে পথে যাওয়ার সময় এসেছে ।’

এদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

শুক্রবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘রায়ের সত্যায়িত কপির জন্য আবেদন করা হয়েছে। রায় ভালোভাবে পড়া হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই রিভিউ আবেদন করা হবে। রায়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা আছে। রিভিউয়ে সেগুলোও আসবে। সরকার তার জন্য তৈরি হচ্ছে। প্রকাশিত রায় এখন পাবলিক ডকুমেন্ট। যে ভাষায় বা যে প্রতিক্রিয়ায় আদালত অবমাননা না হয়, সেভাবেই রায়ের বিষয়ে সমালোচনা করা উচিত অথবা প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত।’