বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি ছিল ‘অকার্যকর’

বাংলাদেশের ৪৭ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিরোধী দল ছিল সরকারেও৷ বিরোধী দল জাতীয় পার্টির তিন জন মন্ত্রী পুরো পাঁচ বছরই দায়িত্ব পালন করেছেন৷ দলের প্রধান এরশাদ ছিলেন মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত৷

এমন বিরোধী দলকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদল৷ আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, ‘অকার্যকর’ বিরোধী দল৷ তবে জাতীয় পার্টির নেতাদের দাবি, তাঁরা সঠিকভাবেই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছেন৷ তাঁরা মনে করেন, সবকিছুতে বিরোধিতা করলেই যোগ্য বিরোধী দল হওয়া যায় না, ভালো কাজের প্রসংশাও করতে হয়৷

শুধু বিরোধিতার বিষয় নয়, সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্যদের উপস্থিতিতেও খুব একটা আগ্রহ ছিল না৷ টিআইবি তার গবেষণায় বলেছে, সংসদ নেতা, প্রধানমন্ত্রী যেখানে ৮৩ ভাগ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন, সেখানে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ উপস্থিত ছিলেন ৫৬ ভাগ অধিবেশনে৷ ফলে বোঝাই যাচ্ছে, বিরোধী নেতার সংসদে খুব একটা আগ্রহ ছিল না৷ এমনকি গত পাঁচ বছরে কোনো আইন প্রণয়নেই তারা ‘না’ ভোট দেয়নি৷

সংসদ অধিবেশন শেষ হয়ে গেল৷ সেখানে দেখা গেছে, বিরোধী দল একদিকে সরকারের সঙ্গেও আছে, আবার অন্যদিকে বিরোধী দলের দায়িত্বও পালন করেছে৷ তারা আসলে কতটা যৌক্তিকভাবে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক তত্ত্বাবধায় সরকারের উপদেষ্টা ও টিআইবির বোর্ড অব ট্রাষ্টি এম হাফিজ উদ্দিন খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটাকে কোনো সংজ্ঞাতেই বিরোধী দল বলা যাবে না৷ তারা সরকারের অংশ৷ তাদের বড় নেতা প্রাইম মিনিস্টারের বিশেষ দূত৷ তিনজন ছিলেন মন্ত্রী৷”

জনাব খান বলেন, ‘‘এটা কি তাহলে বিরোধী দল হলো? এটা একটা লোক দেখানো এবং যাকে আমরা ঠাট্টা করে বলি ‘গৃহপালিত’৷ তারা যদি সরকারে না থাকত, তাহলে তাদের ভূমিকা একটু অন্যরকম হতে পারতো৷ আসলে এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে৷ দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে৷ দরকারের সময় এটা আলোচনায় আসে৷”

দশম সংসদের প্রথম থেকে ১৮ তম অধিবেশন পর্যন্ত টিআইবি মূল্যায়ন করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল৷ সেখানে তারা জাতীয় পার্টির ভূমিকাকে ‘অকার্যকর’ বলেছে৷ এমনকি তাদের পার্টির সদস্যরা নিজেরাই সংসদে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কারণ, সব সময় তারা সরকারের পক্ষেই ভোট দিয়েছে৷ টিআইবি দেখিয়েছে, সংসদের ৭৫ শতাংশের বেশি সময় উপস্থিত থেকেছেন এমন সদস্য মাত্র ৩৪ ভাগ৷ ফলে সংসদের প্রতিও তাদের যে কোনো আগ্রহ ছিল না সেটা বেশ পরিস্কারভাবেই বোঝা যায়৷

একবার সংসদে একজন স্বতন্ত্র এমপি রুস্তম আলী ফারাজী জাতীয় পার্টির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন৷ তখন জাতীয় পার্টিকে রক্ষায় সরকারী দলই এগিয়ে এসেছিল৷ মতিয়া চৌধুরীসহ অনেকেই জাতীয় পার্টির পক্ষে কথা বলেছিলেন৷ এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিরোধী দলের গঠনমূলক ভূমিকার প্রসংসা করেছেন বিভিন্ন সময়৷

জাতীয় পার্টির এমপি ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু তখন সংসদে বলেছিলেন, সরকারে এবং বিরোধী দলে থাকা সারা বিশ্বে একমাত্র দল জাতীয় পার্টি নয়৷ তিনি জার্মানি, ইসরায়েল ও পাকিস্তানের উদাহরণ দেন৷ এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ডেমোক্র্যাট দলের হলেও তাঁর ডিফেন্স মিনিস্টার যে ছিলেন রিপাবলিক দলের, সেটাও উল্লেখ করেছেন৷ তাছাড়া তিনি আরো উল্লেখ করেন, সংবিধানে কোথাও বলা নেই যে, বিরোধী দল সরকারে থাকতে পারবে না৷

সর্বশেষ দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি৷ সেখানে অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন৷ ৩০০ আসন আর সংরক্ষিত ৫০টি মিলিয়ে ৩৫০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৭৬টি৷ জাতীয় পার্টির ৪০টি৷ আওয়ামী লীগের শরিকদের ১৮টি৷ আর ১৬টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হন৷ যদিও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ ছিলেন৷

জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থেকে মানুষের আশা-আকাঙ্খার কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে? জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাদের তো রাজনীতিতেই থাকার কথা না৷ এরশাদের বিরুদ্ধে তো জনঅভ্যুত্থান হয়েছে৷ তারপর আমরা গণতন্ত্রে এলাম৷ সেখানে এসে দেখলাম, তিনি আবার এর মধ্যে ঢুকে গেছেন৷ তাদের আসলে জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই৷ তাদের অবস্থান সব সময় সুবিধাবাদী৷ সরকারে, আবার বিরোধী দলে, এটা তো কৌতুকের মতো হয়ে গেছে৷”

জনাব চৌধুরী বলেন, ‘‘সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এ ধরনের জিনিস পাওয়া যাবে না৷ সাম্প্রতিককালে তো পাওয়া যাবেই না৷ এদের হাতে আসলে টাকা আছে, তারা সরকার এবং বিরোধী দলে থাকার কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রের অভূতপূর্ব ক্ষতি হয়েছে৷ বিরোধী দলের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারের নীতির গঠনমূলক সমালোচনা করা৷ তারা যে কথাগুলো বলেছে, তা সরকারি দলও বলেছে৷ সরকারকে কোনোরকম জবাবদিহিতার মধ্যে তারা আনতে পারেনি৷ আমরা তো দেখেছি, সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী প্রশ্ন করছেন, আমাদের ভূমিকা কী?”

সংসদীয় কাযপ্রণালি বিধিতে বিরোধী দলের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, সেখানে বলা আছে, ‘‘সংসদে সরকারের বাইরে যে সর্ববৃহৎ দল সরকারের বিরোধিতা করবে, সেটিই বিরোধী দল৷ কিন্তু জাতীয় পার্টি সরকারের অংশ হওয়ায় সরকারের কোনো কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতে পারেনি৷ এজন্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, আসন ভাগাভাগির নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে মন্ত্রীসভায় স্থান দেয়ায় প্রকৃত অর্থে দশম জাতীয় সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই৷ তাছাড়া বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সংসদের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাংঘর্ষিক৷ গত পাঁচ বছরে সংসদে জাতীয় পার্টি একটিও ‘না’ ভোট দেয়নি৷ তাই বিরোধী দল হিসেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ৷

তবে জাতীয় পার্টিকে সফল বিরোধী দল মনে করেন পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার৷ ‘‘কতটা সফলভাবে আপনারা দায়িত্ব পালন করেছেন?” ডয়চে ভেলের এ প্রশ্নের জবাবে জনাব হাওলাদার বলেন, ‘‘জাতীয় পার্টি একটা সুশৃঙ্খল পার্টি৷এই পার্লামেন্টে দেশের মানুষের ভালো-মন্দ দুটো বিষয়েই কথা বলেছে জাতীয় পার্টি৷ সরকারের সমালোচনা যেমন করেছে, ভালো কাজের প্রশংসাও তারা করেছে৷ ব্যাংকের টাকা লুট, বিদেশে টাকা পাচার, দুর্নীতি, টাকা না দিলে চাকরি হয় না- এসব বিষয়েও কথা বলেছেন আমাদের এমপিরা৷”

রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘‘বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ মানুষের হাজারো সমস্যার কথা সংসদে তুলে ধরেছেন৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর সেই বক্তব্যের মূল্যায়নও করেছেন৷ অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন৷ সারা দেশেই তো একটা উন্নয়নের ঢেউ লেগেছে৷ আমরা প্রমাণ করেছি যে, শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যায়৷ তাই আমরা বলছি, আসুন, সবাই মিলে দেশটাকে গড়ি৷”

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের জন্মের পর প্রথম সংসদে বিরোধী দল খুব ছোট আকারে ছিল৷ দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ সংসদে আধা গণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দল খুব একটা ভুমিকা পালন করতে পারেনি৷ পঞ্চম ও অষ্টম সংসদে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে৷ ষষ্ঠ সংসদে বিএনপির এক দলীয় নির্বাচনে বিরোধী দল হয় ফ্রিডম পার্টি৷ সপ্তম ও নবম সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করে বিএনপি৷ আর দশম সংসদে প্রথমবারের মতো বিরোধী দলে বসে জাতীয় পার্টি, কিন্তু মানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন তারা ঘটাতে পারেনি৷

-ডয়চে ভেলে