বিশ্বের এক নম্বর ভাষা হিসেবে ইংরেজির দিন কি ফুরিয়ে এলো

বিশ্বজুড়ে ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন কোটি কোটি মানুষ। আজকের দুনিয়ায় ইংরেজি ভাষা হচ্ছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের এক নম্বর মাধ্যম। ইংরেজি ভাষা ছাড়া আন্তর্জাতিক যোগাযোগ যেন কল্পনায় করা যায় না। তবে ইংরেজি ভাষা নাকি তার একচ্ছত্র রাজত্ব হারাতে বসেছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সাংবাদিক রবিন লাস্টিগের মতে, ‘হ্যাঁ’, এটাই যেন হতে চলেছে। ‘ট্রান্সলেশন টেকনোলজি’ বা অনুবাদ প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং ‘হাইব্রিড’ বা নতুন শংকর ভাষা তৈরি হওয়ার ফলে ইংরেজি ভাষার এই অবস্থান এখন হুমকির মুখে।

বিশ্বের কোন দেশটিতে ইংরেজিভাষী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বা কোন দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি ইংরেজি ভাষা শেখেন?-এর উত্তর খুঁজতে মস্তিষ্কের বেশি জ্বালানি খরচ হবে না। সহজ উত্তর-চীন।

কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, চীনের ৩৫ কোটি মানুষের ইংরেজি ভাষায় কিছুটা হলেও জ্ঞান আছে। আর ভারতে আছে আরও ১০ কোটি মানুষের। যুক্তরাষ্ট্রে যত মানুষের প্রথম ভাষা (মাতৃভাষা) ইংরেজি, তার চেয়ে সম্ভবত অনেক বেশি চীনা নাগরিকের দ্বিতীয় ভাষা এটি। (যুক্তরাষ্ট্রের এক পঞ্চমাংশ মানুষ তাদের বাড়িতে ইংরেজি ছাড়া ভিন্ন একটি ভাষায় কথা বলেন)।

কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি কতদিন তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে? বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের হিসাবে পৃথিবীতে এখন ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন ১৫০ কোটি মানুষ। কিন্তু এদের মধ্যে ৪০ কোটিরও কম মানুষের মাতৃভাষা এটি।

এটা সত্যি যে, নানা রকমের ইংরেজি ভাষা চালু আছে পৃথিবীতে। এমনকি খোদ ইংল্যান্ডেরও সব মানুষ একই ধরনের ইংরেজিতে কথা বলেন না। যেমন ধরা যাক ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক বন্দরনগরী পোর্টসমাউথে এখনও আঞ্চলিক ভাষা ‘পম্পেই’ চালু আছে। এটি অনলাইনে তৈরি হওয়া নতুন ধরনের ইংরেজি ভাষা বা আমেরিকান ইংরেজির চ‍্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এখনও টিকে আছে।

ইংরেজি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগাযোগের ভাষা। যখন দুটি মানুষের মাতৃভাষা ভিন্ন হয়, তখন তারা সাধারণত ইংরেজি ভাষাতেই পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। ধরা যাক, চীনের কোনো মানুষের সঙ্গে ফ্রান্সের কোনো মানুষের দেখা হয়েছে। একজন ফরাসি ভাষা বলতে পারেন না। আরেকজন চীনা বলতে পারেন না। এদের দুজন তাহলে কোন ভাষায় কথা বলবেন। সম্ভাবনা খুবই প্রবল যে তারা ইংরেজি ভাষাই বেছে নেবেন। পাঁচ বছর আগে হলে হয়তো এমনটাই হতো।

কিন্তু এখন অবস্থা বদলে গেছে। কম্পিউটারে অনুবাদ প্রযুক্তি এবং ভয়েস রিকগনিজশন টেকনোলজি বা কণ্ঠ শনাক্তকরণ প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে এর দুজনেই এখন কিন্তু তাদের নিজেদের ভাষাতেই কথা বলতে পারেন। যন্ত্র বা প্রযুক্তি সেটা সঙ্গে সঙ্গে অন্যজনকে অনুবাদ করে বলে দেবে।

কাজেই বিশ্ব যোগাযোগের ভাষা হিসেবে ইংরেজির দিন ফুরিয়ে এসেছে। খুব নাটকীয়ভাবে বলতে গেলে : কম্পিউটার আসছে এবং তারাই এই প্রতিযোগিতায় জিতে যাচ্ছে! ধরা যাক, আপনি এই লেখাটাই হয়তো ইংরেজিতে পড়ছেন। আপনার কম্পিউটারে কয়েকটি ক্লিক কিংবা আপনার ট্যাবে আঙুল চেপে এই লেখাটিই হয়তো জার্মান বা জাপানি ভাষাতেও পড়তে পারেন।

কম্পিউটারই যখন আপনার অনুবাদের কাজটি এত সহজে করে দিচ্ছে, তখন কষ্ট করে আর ইংরেজি শেখার কি কোনো দরকার আছে? আপনি যদি আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন কিংবা সর্বশেষ ভিডিও গেম খেলেন বা সর্বশেষ জনপ্রিয় পপসঙ্গীত শুনতে চান, তাহলে ইংরেজি না জানলে আপনার বিপদ। ইংরেজির ওপর যথেষ্ট দখল ছাড়া এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আপনাকে খাবি খেতে হবে।

কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে বেশ দ্রুত। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী ওনকিউম লী একটি গবেষণা করছেন। তার লক্ষ্য এমন এক ভয়েস রিকগনিশন এবং ট্রান্সলেশন প্রযুক্তি তৈরি করা, লোকে যখন কোনো কাস্টমার সার্ভিস হেল্পলাইনে এই প্রযুক্তির সঙ্গে কথা বলবে, তারা বুঝতেই পারবে না এটি মানুষ নাকি কম্পিউটার!

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের মেশিন লার্নিং, লিঙ্গুইস্টিকস অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ম্যানিং। তিনি দাবি করছেন, খুব নিকট ভবিষ্যতেই এই প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করব। তার মতে, ‘কম্পিউটার ট্রান্সলেশন টেকনোলজি’ এতটাই ভালো হবে যে, এটি আসলে মানুষের চেয়েও ভালো অনুবাদকের কাজ করবে।

ইংরেজি ভাষার জন্য চ্যালেঞ্জটা কেবল এদিক থেকে নয়। বিপদ ঘটছে অন্যদিক থেকেও। এতবেশি সংখ্যক মানুষ দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজিতে কথা বলেন যে, নানা রকম হাইব্রিড বা জগাখিচুড়ি ইংরেজি ভাষার বিস্তার ঘটছে বিশ্বে। স্ট্যান্ডার্ড বা সত্যিকারের ইংরেজি ভাষার কিছু কিছু অংশের সঙ্গে স্থানীয় ভাষা মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব ভাষা। যেমন ভারতেই আপনি শুনতে পাবেন হিংলিশ (হিন্দি-ইংলিশ), বেংলিশ (বেঙ্গলি-ইংলিশ) এবং তাংলিশ (তামিল-ইংলিশ)।

যুক্তরাষ্ট্রে অনেক হিস্পানিক আমেরিকান তাদের মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চায়। তারা ইংরেজি এবং তাদের বাবা-মা বা তারও আগের প্রজন্মের অভিবাসী পিতামহদের ভাষা মিলিয়ে তৈরি করেছে এক নতুন ভাষা-স্প্যাংলিশ।

ভাষা আসলে শুধু যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নয়, তারচেয়েও বেশি কিছু। এটি মানুষের আত্মপরিচয় প্রকাশের হাতিয়ার। ভাষা শুনে আমরা একজন মানুষ আসলে কী, তা বুঝতে পারি। সানফ্রান্সিসকোর কবি জোসিয়াহ লুইস অলডারেট কবিতা লেখেন স্প্যাংলিশে। তিনি এটিকে বর্ণনা করেন প্রতিরোধের ভাষা হিসেবে। তার মতে, এই ভাষার মাধ্যমে হিস্পানিক আমেরিকানরা তাদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখে, সেটা নিয়ে গর্ব অনুভব করে। যদিও তাদের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে, বেড়েও উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রে।

বিশ্বজুড়ে ইংরেজি ভাষার যে আধিপত্য আমরা আজকে দেখি, তার মূলে কিন্তু রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন। এই সেদিনও যারা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি দেশ। কিন্তু এখন নতুন অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের ফলে ইংরেজির আধিপত্য এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।

আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলের কোন দেশে একজন কর্মপ্রত্যাশী বেকার তরুণ ইংরেজি বা ম্যান্ডারিন চাইনিজ-এই দুই ভাষার কোনটি শিখতে বেশি আগ্রহী হবে? ক্যারিয়ারের বিবেচনায় ইংরেজি শিখে যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনে গিয়ে কাজ খোঁজার চেয়ে তার কাছে ম্যান্ডারিন শিখে চীনে যাওয়া কিন্তু অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

শুধু আফ্রিকায় নয়, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও চীনা ভাষা শেখাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২০১৫ সালের এক খবরে বলা হচ্ছিল, সেখানে স্কুলপর্যায়ে ম্যান্ডারিন শিখছে-এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দুই বছরের মধ্যেই দ্বিগুণ হয়েছে। আর কলেজ পর্যায়ে তা দশ বছরে বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

তবে উগান্ডায় সব মাধ্যমিক স্কুলে লেখাপড়ার মাধ্যম কিন্তু পুরোপুরি ইংরেজি। অনেক বাবা-মা তো ইংরেজিকেই প্রথম ভাষা হিসেবে শেখান তাদের ছেলে-মেয়েদের। বিশ্বের অনেক জায়গাতেই এখনও ইংরেজিকে সাফল্যের চাবিকাঠি বলে গণ্য করা হয়।

তাহলে ইংরেজির ভবিষ্যৎ কি হুমকির মুখে? না, বিবিসির এই সাংবাদিকের মতে, সামনের দশকগুলোতে বিশ্বজুড়ে এটির প্রাধান্য হয়তো কমতে থাকবে। তবে আর সব ভাষার মতো ইংরেজি বদলাতে থাকবে এবং নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে থাকবে।

একটা উদাহরণ দেয়া যাক। এই সেদিনও কিন্তু ইংরেজিতে ‘টেক্সট’ এবং ‘ফ্রেন্ড’ ছিল সিম্পল ‘নাউন’ বা ‘বিশেষ্য’। এখন কিন্তু আমরা দুটি শব্দকেই ‘ভার্ব’ বা ‘ক্রিয়াপদ’ হিসেবে ব্যবহার করছি। যেমন : আই উইল টেক্সট ইউ বা হোয়াই ডোন্ট ইউ ফ্রেন্ড মি?

‘কম্পিউটারে ট্রান্সলেশন প্রযুক্তি, হাইব্রিড বা শংকর ভাষার বিস্তার এবং চীনের উত্থান- এসব ইংরেজির জন্য সত্যিকারের হুমকি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি এ কারণে যে, এমন এক দেশে আমার জন্ম, আমি শেক্সপীয়ার, চসার, মিল্টন বা ডিকেন্সের ভাষাকে নিজের ভাষা বলে গণ্য করতে পারি। যদিও এখন যাকে আমি ইংরেজি ভাষা বলছি, সেটি তাদের আমলের ইংরেজি থেকে অনেক আলাদা’-যোগ করেন এই সাংবাদিক।

সূত্র: বিবিসি বাংলা