বেশির ভাগ নারী চা শ্রমিক জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত

চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে দেশের চা শ্রমিকরা। চা শ্রমিকদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী প্রাথমিকভাবে জরায়ুমুখে ক্যান্সারে আক্রান্ত এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে গবেষণামূলক সংস্থা সিআইপিআরবির এক জরিপে। দেশে মোট চা বাগান ১৬৪টি। এতে প্রায় ৯ লক্ষ জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী শ্রমিক। এই অর্ধেক নারী শ্রমিকের ১৫ শতাংশের শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার।খবর জাগো নিউজের।

মৌলভীবাজারের রাজঘাট, খেজুরীছড়া, আমরাইলছড়া, সাঁতগাও, হোসেনাবাদ, আলীনগর, শমসেরনগর, মিরতিংগা, মাধবপুরসহ ১০টি বাগানে পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু দেশের সব চা বাগানে একই কাজ ও বাসস্থানের পরিবেশ বিদ্যমান সেহেতু চা বাগানগুলোতে একই অবস্থা থাকার সম্ভবনা প্রবল।

ইতোমধ্যে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) অর্থায়নে জাতীয় স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও গবেষণামূলক সংস্থা সিআইপিআরবির কারিগরি সহযোগিতায় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে মৌলভীবাজার জেলার চা বাগানে প্রজনন ও মাতৃস্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে বিবাহিত নারীদের জরায়ুমুখের ক্যান্সার সনাক্তকরণের জন্য বিনামূল্যে ‘ভায়া’ টেস্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

মৌলভীবাজার জেলার ফাঁড়ি বাগানসহ ৯৩টি চা বাগানের মধ্যে দশটি চা বাগানে মোট তিন হাজার নারীর ভায়া টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ৫১৯ জন দূরারোগ্য ক্যান্সার নামক ব্যাধিটি পজিটিভও এসেছে।

এই ভায়া টেস্টের যে ভয়াবহ ফলাফল এসেছে তা চমকে দেয়ার মতো। তথ্যমতে চা বাগানে কর্মরত নারীদের শতকরা ১৫ জনের জরায়ুমুখে ক্যান্সারের লক্ষণ পাওয়া গেছে। এই কার্যক্রমে অংশ নেয়া নারীরা সাধারণত ২১ থেকে ৬৫ বছরের।

বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে বসবাসকারী পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির নাম চা শ্রমিক। যেসব কারণে নারীদের জরায়ুমুখের ক্যান্সার হয় তার সব লক্ষণ রয়েছে চা বাগানে। দিনের পর দিন চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের স্বাস্থ্য সেবাসহ মৌলিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেও স্বাভাবিক জীবন পাচ্ছেন না। চা বাগানে শিক্ষার অভাব থেকে ক্যান্সার তথা স্বাস্থ্য নিয়ে অসচেতনতা, কাজের নোংরা পরিবেশ, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতা যা জরায়ূমুখে ক্যান্সারের জন্য দায়ী।

বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, মূলত বাল্য বিবাহ, বেশি সন্তান নেয়া, অসচেতনতা, অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্নতা ও নিয়ন্ত্রণহীন যৌনাচারের ফলে জরায়ূমুখে ক্যান্সারের সূত্রপাত হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আক্রান্ত নারীদের লেটেস্ট ডায়াগনস্টিক টুল ভিডিও কল্পস্কোপির মাধ্যমে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এদের ‘ভিডিও কল্পস্কোপি’র মাধ্যমে ‘সারভাইকেল ক্যান্সার’ কোন স্টেজে আছে সে অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে।

প্রাথমিকভাবে জরায়ুমুখে ক্যান্সার সনাক্তকৃত মিরতিংগা চা বাগানের রুপা উরাং, অঞ্জনা ভূমিজ, রূপালী গোয়ালাসহ কয়েকজন নারীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বিভিন্নভাবে চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত এই নারীরা প্রাথমিকভাবে ক্যান্সারের লক্ষণ ধরা পড়ার আগেই সচেতন হতে পারছেন। এবং চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ থাকার স্বপ্ন দেখছেন।

মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা হাসপাতালের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাইনিকোলজিস্ট ডা. ফারজানা হক পর্ণা জানান, এই রোগের একটি বিশেষায়িত সেবা এখন বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, জরায়ুমুখের ক্যান্সার সনাক্তকরণের নিমিত্তে লেটেস্ট ডায়াগনস্টিক টুল ‘ভিডিও কল্পস্কোপি’র মাধ্যমে ‘সারভাইকেল ক্যান্সার’ কোন স্টেজে আছে, তা প্রি-ইনভেসিভ কী না, বায়োপসি করা লাগবে কী না, এসব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে।

সিআইপিআরবির জেলা সমন্নয়কারী মো. আলতাফুর রহমান জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ইউএনএফপিএ ও সিআইপিআরবি’র যৌথ উদ্যোগে দশটি চা বাগানে মোট তিন হাজার নারীর ভায়া টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ৫১৯ জনের জরায়ুমুখের ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা (ভায়া পজিটিভ) সনাক্তকরণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জরায়ুমুখের ক্যান্সারপূর্ব অবস্থা সনাক্তকৃত ৫২৩ জন নারীকে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক পার্থ সারথী দত্ত কাননগো জানান, সিলেট বিভাগের মধ্যে এই সেবাটি শুধু মৌলভীবাজারে দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভোজন কৈরী জানান, আমরা বহুদিন ধরেই দারি করে আসছিলাম চা শ্রমিকরা আধুনিক ক্রীতদাস। এখানে সামান্য স্বাস্থ্যসেবাটুকুও ঠিকমতো মিলে না।

বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলি বলেন, চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সেবাসহ জীবনমান উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ করছি। স্বল্প সংখ্যক বাগান ছাড়া সব বাগানেই চিকিৎসার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা আছে। তিনি আরও জানান, আমরা শ্রমিকের চিকিৎসার প্রয়োজনে সব ধরনের প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।