বেহাল সড়ক, পর্যটক কমছে সিলেটে

সিলেটে হঠাৎ করে কমে গেছে পর্যটকদের আনাগোনা। গত রমজানের ঈদের তুলনায় এ বছর পর্যটক উপস্থিতি অর্ধেকেরও কম। ঈদে অনেকে হোটেল বুকিং দিয়েও শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছে বলেও জানা গেছে। এতে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা পড়েছে মারাত্মক ক্ষতির মুখে। পর্যটন স্পটগুলোতে যাওয়ার সড়কগুলো দীর্ঘদিন ধরে নাজুক থাকায় এর প্রভাব পর্যটনশিল্পে পড়তে শুরু করেছে। পাশাপাশি আবহাওয়া এবং বন্যা পরিস্থিতিকেও দায়ী করছে তারা।

সিলেটের সুন্দরবনখ্যাত রাতারগুল জলাবনে সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। ঈদের ছুটিতে উপস্থিতি থাকে সবচেয়ে বেশি। এ সময় সপ্তাহ ধরে গিজগিজ করে পর্যটকরা। কিন্তু এ বছর চিত্র ঠিক উল্টো। পর্যটকদের উপস্থিতি নেই তেমনটা। স্থানীয় বাসিন্দা ছিফত মিয়া রাতারগুলে নৌকায় করে পর্যটকদের রাতারগুলের সৌন্দর্য দেখিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন। সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন দুই ঈদের এ সময় পর্যটকদের উপস্থিতি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। আয়-রোজগারও বেশি হয়। এবার লোকজনের আনাগোনা কমে যাওয়ায় হতাশ ছিফাত জানান, এ বছর পর্যটকরা এসেছে কম। এ রকমসংখ্যক পর্যটক সারা বছরই থাকে। একই কথা মজারুল মিয়া, আনা মিয়া মাঝিরও। তাঁদের কথার মিল পাওয়া গেল সিলেট নগরের দর্শদেউড়ি এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী সাজ্জাদুল ইসলাম জুয়েলের কণ্ঠে। কয়েক বছর ধরে প্রতিবছর ঈদে তিনি রাতারগুল ও বিছনাকান্দিতে ঘুরতে যান। তিনি বলেন, ‘এ বছর সিলেটের প্রতিটি পর্যটন স্পটেই মানুষের উপস্থিতি কম। হালের ক্রেজ রাতারগুল বা বিছনাকান্দি শুধু নয়, এবার পর্যটক উপস্থিতি কম সিলেটের প্রায় প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রেই। একই চিত্র সিলেটের পুরনো পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়েও। পর্যটক কমেছে লালাখাল, মায়াবী ঝরনা, পাংতুমাইসহ সব পর্যটনকেন্দ্রেই। যারা এসেছে তাদের বড় অংশ স্থানীয়।

প্রকৃতিকন্যা নামে পরিচিত জাফলংয়েও এবার পর্যটক উপস্থিতি কমেছে। জাফলং ভিউ রেস্টুরেন্টের পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, ‘বেহাল সড়ক ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে গত বছরের তুলনায় এবার পর্যটক কম হয়েছে। আমাদের বেচাকেনাও অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে এবার।’

পর্যটক কম হওয়ার জন্য রাস্তার নাজুক অবস্থা এবং বন্যা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেওয়াকে দায়ী করেছেন জাফলং ট্যুরিস্ট গাইড আন্ড হ্যান্ড বোট যুবসংঘের প্রতিষ্ঠাতা হালিম আল মামুন বলেন, ‘নদীতে পানি থাকায় বেশির ভাগ পর্যটকের চাহিদা এখন হ্যান্ড বোট (হাতেচালিত নৌকা)। তাই ঈদে আমাদের ব্যস্ততা একটু বেশি। যদিও এবার আশানুরূপ পর্যটক হয়নি।’

পর্যটক উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন জাফলং ট্যুরিস্ট পুলিশের ইনচার্জ দেবাংশু কুমার দে। তিনি গতকাল বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর পর্যটক উপস্থিতি কম। ঈদের সপ্তাহজুড়ে যেখানে লাখের ওপর পর্যটকদের আনাগোনা থাকে, সেখানে আজকে পর্যটকদের কয়েক হাজারের মতো হবে। ঈদের দিন পর্যটকদের উপস্থিতি চার-পাঁচ হাজারের মতো ছিল।’ রাস্তাঘাটের বেহাল ও আবহাওয়ার বৈরিতার জন্য এবার মানুষের আনাগোনা কম বলে মনে করছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

জানা গেছে, সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের অবস্থাও খারাপ। এছাড়া সিলেট থেকে বিভিন্ন পর্যটন স্পটে যাওয়ার সড়কগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। সিলেট-জাফলং, সিলেট-রাতারগুল, সিলেট-বিছনাকান্দি সড়কসহ সবগুলো সড়কই ভাঙ্গাচোরা পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। সড়ক সংস্কারের দাবি দীর্ঘদিন ধরে করা হলেও এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ উদাসিন। আর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সিলেটের পর্যটন শিল্পে। হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাগুলোও এবার আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেনি। ঈদের আগেরদিন থেকে সপ্তাহজুড়ে যেখানে সিলেটের হোটেলগুলোতে কক্ষ খালি পাওয়া যায় না সেখানে ঈদের দুইদিনও অনেক হোটেলে অর্ধেক কক্ষ খালি ছিল। নগরের জিন্দাবাজার এলাকার হোটেল গোল্ডেন সিটির ব্যবস্থাপক মৃদুল কান্তি দত্ত জানান, আগে বুকিং না দিলে যেখানে ঈদের এক সপ্তাহের মধ্যে রুম খালি পাওয়া যেত না সেখানে আমাদের হোটেলে ঈদের দিন ১৬টি কক্ষ খালি ছিল। সর্বশেষ কবে এরকম হয়েছিল মনে করতে পারছি না।

অনেকে বুকিং দিয়েও পরে তা বাতিল করিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেকটি পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তার বেহাল দশা দীর্ঘদিন ধরে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসিনতার প্রভাব পর্যটন শিল্পে পড়তে শুরু করেছে।

তবে এ বছর পর্যটক কম হওয়ার জন্য বন্যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, গণমাধ্যমগুলোতে সংবাদ আসছে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি। এখন মৌলভীবাজারের মতো অবস্থা তো সিলেটে নয় কিংবা পর্যটন স্পটগুলোতে নয়। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ ধরে নিয়েছেন সিলেট বোধহয় ডুবে আছে। সেকারণে অনেকে আর ঝুঁকি নেননি।

এ বিষয়ে সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি খন্দকার শিপার আহমদ বলেন, ‘সিলেট শহর থেকে সব পর্যটন স্পটে যাওয়ার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ। দীর্ঘদিন ধরেই এসব সড়ক নাজুক অবস্থায় রয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে পর্যটনশিল্পে। এবার সিলেটে তেমন পর্যটক আসেননি।’ তিনি বলেন, ‘সড়কব্যবস্থার দুরবস্থার কারণে শুধু পর্যটনশিল্প নয়, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যও ব্যাহত হচ্ছে।’

সিলেট হোটেল ও গেস্ট হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তাহমিন আহমদ বলেন, ‘আগে যেকোনো ছুটিতে সিলেটে পর্যটকদের ঢল নামত। বেড়াতে এসে তারা কয়েক দিন সিলেটে অবস্থান করত। নানা কারণে এখন পর্যটকরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের শিলং চলে যাচ্ছে। যাওয়া-আসার ফাঁকে হয়তো এক রাত সিলেটে থাকছে; কিন্তু দীর্ঘ সময় এখানে অবস্থান করছে না তারা। এতে এখানকার উদ্যোক্তারা ক্ষতির মুখে পড়েছে।’