বৈষম্যে ‘পূর্ব পশ্চিমে’ বিভক্ত বাংলাদেশ : সিপিডি

ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল দরিদ্র্যরা পাচ্ছে না বলে দাবি করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। এ কারণে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে বলে মনে করে তারা।

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যায়ন করতে গিয়ে সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শুক্রবার বলেন, বাংলাদেশ বৈষম্যের কারণে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলের বৈষম্যের বিষয়টির সঙ্গে তুলনা করে তিনি ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন।

বৃহস্পতিবার ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর মধ্যে উন্নয়নে বরাদ্দ থাকছে এক লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি রয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হবে ৭১ হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা আসবে বিদেশি ঋণ থেকে।

আগামী অর্থবছরে ৭.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী। আর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫.৬ শতাংশ। আর বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ হারে কমানোর ঘোষণাও এসেছে।

গত এক দশকে প্রবৃদ্ধির গড় হার ৬.৬ হয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী এটিকে ১০ এর ধরে নিয়ে যেতে চান। এ জন্য শাসন ব্যবস্থার সংস্কার করে আগামী বছর থেকে ৬৪ জেলা এবং মহানগরে ‘স্বয়ম্ভর’ সরকার প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছেন। দিয়েছেন সার্বজনীন পেনশনের রূপরেখা।

সিপিডি ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, বাংলাদেশে উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি হলেও সেটির সুফল সমাজের একেবারে নিম্নস্তরে পৌঁছতে পারছে না। এ কারণে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি কমেছে, আর বাড়ছে বৈষম্য।

‘গেল পাঁচ বছরে ভালো প্রবৃদ্ধি বাড়লেও আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। গরিব মানুষের সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমেছে। বাংলাদেশ পূর্ব পশ্চিমে ভাগ হয়ে গেছে। উন্নতর বাংলাদেশ আর দরিদ্রতম বাংলাদেশে বিভক্ত হয়ে গেছে। বৈষম্যের পরিমাণ বেড়েছে।’

‘সবচেয়ে কম আয়ের ৫ শতাংশ মানুষের এ সময়ে ৫ বছরে ৬০ শতাংশের মতো আয়ের ক্ষয় ঘটেছে। অন্যদিকে সবচেয়ে যারা উঁচু আয়ের ৫ শতাংশ মানুষের ৫৭ দশমিক ৪ শতাংশ আয়ের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে।’

দেবপ্রিয় বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির হার উঁচু হতে পারে, নিচুও হতে পারে কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি জনসাধারণ মানুষের দারিদ্র কমাতে হবে।’

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপের মুখে দেশে সাম্যবাদী সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে বাজেট কতটুকু অন্তর্ভূক্তিমূলক হবে তা নিয়েও সংশয় জানিয়েছে সিপিডি।

প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সংশয়

আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে, সেটি অর্জন করা কঠিন হবে বলেও মনে করেন দেবপ্রিয়। বলেন, ‘লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা বাড়াতে হবে, একই সঙ্গে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। পুঁজির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।’

‘এটি বাস্তবে করা অনেক কঠিন, এজন্য জিডিপির এই প্রবৃদ্ধি নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে।’

সিপিডি অবশ্য বরাবর প্রবৃদ্ধি নিয়ে এ্ই সংশয় প্রকাশ করে আসছে। চলতি (২০১৭-১৮) বাজেটে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরার পরেও এ নিয়ে সংশয় জানিয়েছিল সিপিডি। কিন্তু এরই মধ্যে সেটি ৭.৬৫ শতাংশ হয়ে গেছে। চূড়ান্ত হিসাবে এটি আরও বাড়বে।

প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতির যে প্রাক্কলন করেছেন, সেটি ধরে রাখা কঠিন হবে বলেও মনে করছে সিপিডি।

করপোরেট কর কমানোর সমালোচনা

ব্যবসায়ীদের ক্রমাগত নিবেদনের মুখে অর্থমন্ত্রী গত বছরই করপোরেট করে ছাড় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আগামী অর্থবছরে তিনি আড়াই শতাংশ হারে কর ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছেন। আর এতে বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে বলে আরও আড়াই শতাংশ ছাড়ের দাবি জানানো হয়েছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ডিসিসিআই থেকে।

তবে দেবপ্রিয় মনে করেন, করপোরেট করে ছাড় দেয়া উচিত হয়নি। বিশেষ করে ব্যাংক ব্যবস্থায় এই ছাড়ের বিপক্ষে তিনি। বলেন, ‘এক্ষেত্রে মালিকপক্ষেরই বেশি লাভ হবে।’

‘নৈরাজ্য বন্ধ না করে ব্যাংক ব্যবসায়ীদের চাপে করপোরেট করহার কমানোর সিদ্ধান্ত অনিয়ম উসকে দেবে। কেন এ কর কমানো হয়েছে তার পেছনে যৌক্তিক ও প্রশাসনিক কোনো কারণ দেখছি না।’

রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করাও কঠিন হবে বলে মনে করেন সিপিডির ফেলো। বলেন, রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য পূরণ না হলে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়বে।

বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করলেও সরকারকে অধিক সুদে সঞ্চয়পত্রের ঋণে ঝুঁকতে হবে বলে মনে করেন দেবপ্রিয়। বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রের ওপর চাপ কমিয়ে ব্যাংকিং খাতকে চাঙ্গা করা উচিত ছিল।’

‘এটি স্থিতাবস্থার বাজেট’

বাজেটে কোনো নতুনত্ব নেই বলেও মনে করেন দেবপ্রিয়। বলেন, ‘চলতি অর্থবছর যা ছিল আগামী অর্থবছরেও তাই রয়েছে। তাই এক কথায় এ বাজেটকে স্থিতাবস্থার বাজেট বলে অবিহিত করা যায়।’

রোহিঙ্গাদের জন্য কী পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে সেরকম কোনো আর্থিক মূল্যায়ন করা হয়নি বলেও সমালোচনা করেন দেবপ্রিয়।