ভাইয়া, ওরা আমাকে মারবে না তো?

‘ভাইয়া, ওরা আমাকে মারবে না তো?’ প্রশ্নটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শেখ রাসেলের।

ঘাতকের বুলেটের আঘাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বড় ভাই শেখ কামাল ও জামাল, তাদের স্ত্রী সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।

ঘাতকরা শিশু রাসেলকে দোতলা থেকে নিচে নামিয়ে আনে। নিচে এসে মহিতুলকে (বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী) দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে এমন প্রশ্ন রাখে শিশু রাসেল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী মহিতুল ইসলাম পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমার তখন ধারণা হয়েছিল, বিশ্বাস করেছিলাম, খুনিরা হয়তো মাসুম বাচ্চা শিশু রাসেলকে মেরে ফেলবে না। এমন ধারণার বশেই আমি রাসেলকে বলি, ‘না, ভাইয়া তোমাকে কেউ মারবে না’।”

নির্মম ওই হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে ফেরা মহিতুল ইসলাম ওই সময় ছিলেন সতের বছরের তরুণ। পুরো নাম আ ফ ম মহিতুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ির রিসিপশনিস্ট ছিলেন তিনি। কিশোর মহিত পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পিতৃস্নেহ। বেগম মুজিবও তাকে খুব আদর করতেন। গত বছরের (২০১৬ সাল) ২৫ আগস্ট ইন্তেকাল করেন বঙ্গবন্ধুর এই স্নেহধন্য।

মৃত্যুর আগে বিভিন্ন দৈনিকে সাক্ষাৎকার দেন মহিতুল। সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা তুলে ধরেন তিনি। সেখানে শেখ রাসেলের হত্যাকাণ্ডই অধিক ব্যথিত করেছে বলে উল্লেখ করেন ইতিহাসের জঘন্যতম ওই হত্যাকাণ্ডের এ প্রত্যক্ষদর্শী।

ঘটনার বর্ণনার একাংশে মহিতুল বলেন, “পাশে দাঁড়ানো এক আর্মি বলতে থাকেন, ‘শেখ মুজিব ইজ বেটার দ্যান নাসের।’ যে অস্ত্রধারী লোকটি শেখ নাসেরকে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে, আপনাকে কিছু বলব না। আপনি ওই রুমে গিয়ে বসুন।’ এই কথা বলে শেখ নাসেরকে আমাদের রুমের এটাচ বাথরুমে নিয়ে ওরা গুলি করে। যখন ওই অস্ত্রধারী লোকটি আমাদের লাইনের দিকে ফিরে আসছিলেন, বাথরুম থেকে শেখ নাসের এ সময় ‘পানি’ ‘পানি’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। আরেকজন আর্মির লোক বলেন, ‘যা ওকে পানি দিয়ে আয়।’ অস্ত্রধারী ওই লোকটি তখন শেখ নাসেরকে পানি না দিয়ে ফের গুলি করে।”

তিনি বলেন, “এর মধ্যে শিশু রাসেলকে ওপর থেকে নিচে নিয়ে আসে অস্ত্রধারীরা। নিচে এসেই আমাকে রাসেল জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভাইয়া, ওরা আমাকে মারবে না তো?’ আমার তখন ধারণা হয়েছিল, বিশ্বাস করেছিলাম, খুনিরা হয়তো মাসুম বাচ্চা শিশু রাসেলকে মেরে ফেলবে না। এমন ধারণার বশেই আমি রাসেলকে বলি, ‘না, ভাইয়া তোমাকে কেউ মারবে না’।”

রাসেলের সঙ্গে আমার এমন কথোপকথন চলাকালীন আর্মির এক লোক রাসেলকে জোর করে আমার কাছ থেকে নিয়ে যায়। রাসেল তখন মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছিল। রাসেলকে পুলিশ বক্সের মধ্যে রাখা হয়েছিল। তখন রাসেল বলছিল, ‘আমি মার কাছে যাব। মার কাছে যাব।’ ওপর থেকে একজন ঘাতক এসে বলল, ‘যা, ওকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যা।’ এ কথা শোনার পর আমার মনে হলো, হয়তো বেগম মুজিব বেঁচে আছেন। রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ওরা তাকে ওপরে নিয়ে যায়। এরপরই গুলির শব্দ শুনি।

“যে রাসেল আমার সঙ্গে এত দুষ্টুমি করত, সেই রাসেল আমার সামনে থেকে হেঁটে গেল। একটা নিস্তব্ধ পাথর মনে হলো সরে যাচ্ছে। শেখ রাসেলের হত্যাকাণ্ড ছিল ওই বাড়ির শেষ হত্যাকাণ্ড। তখন গেটের সামনে বজলুল হুদার কাছে মেজর ফারুক কী যেন জিজ্ঞাসা করে। বজলুল হুদাকে বলতে শুনি,‘অল আর ফিনিশড’।”