ভারতেও এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ঘটাচ্ছে ‘ফারাক্কা’

তেতাল্লিশ বছর আগে ভারতে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে লং মার্চে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজনীতিবিদ মৌলানা ভাসানি।

তখন থেকেই বাংলাদেশে ১৬ই মে দিনটি ‘ফারাক্কা লং মার্চ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে, যদিও বিগত পাঁচ দশকে ফারাক্কা নিয়ে ভারতের অনড় অবস্থানে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।

কিন্তু খুব সম্প্রতি ভারতেও ফারাক্কার বিরুদ্ধে জনমত জোরালো হচ্ছে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তো ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে ফেলারও প্রস্তাব করেছেন।

মেধা পাটকরের মতো অ্যাক্টিভিস্ট ও অনেক বিশেষজ্ঞও বলছেন, ভারতেও ফারাক্কা এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ঘটাচ্ছে – কাজেই এটি অবিলম্বে ‘ডিকমিশন’ করা দরকার।

বস্তুত সাতের দশকের মাঝামাঝি ভারত যখন গঙ্গার বুকে ফারাক্কা ব্যারাজ চালু করেছিল, তার পর থেকে বিতর্ক কখনওই এই প্রকল্পটির পিছু ছাড়েনি।

ফারাক্কা থেকে মাত্র বিশ কিলোমিটার দূরে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে যেমন এই ব্যারাজের মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়েছে – তেমনি ভারতেও কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ফারাক্কা নানা ধরনের বিপদ ডেকে এনেছে।

বিহারের গাঙ্গেয় অববাহিকায় প্রতি বছরের ভয়াবহ বন্যার জন্য ফারাক্কাকেই দায়ী করে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তো এই বাঁধটাই তুলে দিতে বলেছিলেন।

ভারতে নামী সংরক্ষণ অ্যাক্টিভিস্ট ও নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের নেত্রী মেধা পাটকর বলছিলেন, “একটা বাঁধের প্রভাব যদি খুব ধ্বংসাত্মক হয়, ফারাক্কাতে যেটা হয়েছে, তাহলে সেটা ডিকমিশন করার অসংখ্য নজির কিন্তু দুনিয়াতে আছে।”

“আমেরিকাতেও শতাধিক ড্যাম ভেঙে দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“নীতিশ কুমার ফারাক্কা ভাঙার প্রস্তাব দিলেও সে ব্যাপারে বিশেষ কিছু করেননি, সত্যিকারের সোশ্যালিস্ট রাজনীতিতে বিশ্বাস করলে তারও এতদিনে গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।”

সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভার্স অ্যান্ড পিপলের কর্ণধার ও নদী-বিশেষজ্ঞ হিমাংশু ঠক্করও জানাচ্ছেন, একটা বাঁধ ডিকমিশন করার আগে কয়েকটা জিনিস খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয় – দেখতে হয় লাভ-ক্ষতির পাল্লাটা কোন দিকে ভারী।

“ফারাক্কার ক্ষেত্রে সেই স্টাডিটা এখনও শুরু করা হয়নি। কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট – ফারাক্কার মূল উদ্দেশ্য যেটা ছিল সেই কলকাতা বন্দরকে কিন্তু আজও বাঁচানো যায়নি।”

“কলকাতা বন্দর টিঁকিয়ে রাখতে আজ যে পরিমাণ ড্রেজিং করতে হয়, ফারাক্কা চালু হওয়ার আগেও ততটা করতে হত না। এটাকে একটা প্রতীক ধরলে ফারাক্কা তো ভেঙে ফেলাই উচিত”, বলছেন হিমাংশু ঠক্কর।

মি ঠক্কর আরও জানাচ্ছেন, ফারাক্কায় গঙ্গার ওপর রেল ও সড়ক-সেতু এখনকার মতো রেখে দিয়েই ব্যারাজটা সরিয়ে দেওয়া সম্ভব – ইউরোপ আমেরিকাতে তা অনেক জায়গাতেই হয়েছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ সুমনা ব্যানার্জিও বলছিলেন, ফারাক্কার জন্য গঙ্গায় এত বেশি পলি জমছে যে তাতে দুপারের জমি ভাঙছে, জনপদ প্লাবিত হচ্ছে।

তার কথায়, “প্রতি বছরই আমরা ফিল্ড ট্রিপে সেখানে যাই। পাঁচ-ছবছর আগে যখন মালদার পঞ্চানন্দপুরের ভাঙন খতিয়ে দেখতে যাই, তখন দেখেছিলাম ফারাক্কার বুকে মাঝগঙ্গাতেও কিন্তু বক দাঁড়িয়ে আছে।”

“এই ছবিটাই বলে দেয় গঙ্গাতে কী পরিমাণ সিল্টেশন জমছে বা সেডিমেন্টেশন হচ্ছে। আর সেই সিল্টেশন ঠেকানোর ক্ষমতা যদি ফারাক্কার না-থাকে, তাহলে তো গোটা ব্যারাজটাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়, তাই না?

“আমরা ফারাক্কাকে এই অবস্থাতেই ফেলে রেখেছি যেখানে এত বিপুল পরিমাণ সেডিমেন্টেশন হচ্ছে যে নদীর চ্যানেলটার আর জল ধরে রাখার ক্ষমতা নেই – আর সেটা দুপারে উপছে পড়ছে।”

“স্থানীয় একজন গ্রামবাসী সুন্দর উপমা টেনে বলেছিলেন, সাপের মুখটা জোরে ধরে রাখলে সাপটা যেমন ছটফট করে, নদীটাও এখানে সেভাবে ছটফট করছে। আর সাপের মুখটা ধরে রাখা হচ্ছে এই ফারাক্কা ব্যারাজ!”

মেধা পাটকরেরও কোনও সংশয় নেই, ভারতের জন্যও ফারাক্কা এখন যত না উপযোগী – তার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংস ডেকে আনছে।

তিনি পরিষ্কার জানাচ্ছেন, “না ভাটিতে, না উজানে – ফারাক্কার প্রভাব কোথাওই সুখকর হয়নি। বলা হয়েছিল ফারাক্কা বন্যা রুখতে পারবে, অথচ দেখা গেছে বন্যা আর খরার চক্র ঘুরেফিরে এসেছে।”

“ফারাক্কার অভিজ্ঞতা আমাদের এটাই শিখিয়েছে যে বড় নদীর বুকে জল নিয়ে খেলতে নেই।”

“তুমি বরং সেই জলটাকে ক্যাচমেন্টে আটকাতে পারো, বড় নদীতে মেশার আগেই সেই জলটা কাজে লাগিয়ে নিতে পারো।”

প্রায় অর্ধশতাব্দীর পুরনো ফারাক্কা ব্যারাজ যে ভারতের আর বিশেষ কোনও কাজে আসছে না – বরং নানা ধরনের পরিবেশগত বিপদ ডেকে আনছে বিশেষজ্ঞরা অনেকেই তা খোলাখুলি বলছেন।

তবে ফারাক্কা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাজনৈতিক স্তরেই, বছর তিনেক আগে নীতীশ কুমারের প্রকাশ্য দাবির পরেও সে কাজে কিন্তু খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।