ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে বাংলাদেশের নির্বাচন

বাংলাদেশের একাদশ সাধারণ নির্বাচনের এক মাস বাকি থাকতেই প্রতিবেশী ভারতের সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষকরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সংশ্লিষ্ট কট্টর ডানপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের পক্ষেই বেশি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে। এর তুলনায় ভারতের উদারপন্থী রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা আওয়ামী লীগের বিষয়ে সমালোচনামূলক মনোভাব নিয়েছেন।

বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোও ভারতীয় বিশ্লেষকদের বিভক্ত করেছে। বাংলাদেশের চলমান শান্তি ও অর্জিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সন্তুষ্ট ডানপন্থী ‘জাতীয়তাবাদী’ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। এই সন্তোষ প্রকাশে তাদের কার্পণ্য নেই। তাদের স্থির বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত খেতে ও পরতে পাওয়া সন্তুষ্ট জনগোষ্ঠী আরও বেশি নিরাপদ থাকবে, যেকোনও ক্ষমতাসীন দলের জন্য এটাই সমর্থনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ‘দ্রুত অর্থনেতিক উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষকে খুশি রাখতে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে অন্য কোনও দলই বেশি কিছু করতে পারেনি। এই অর্জন সহজ নয়’, বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি’র আইন শাখার প্রধান শান্তনু সিনহা। তিনি বলেন, ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মসূচিতে তাদের সাফল্য দেখুন, আমাদের কয়েকটি অঞ্চলের চেয়ে তাদের অর্জন ভালো’।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে আসা এক সাংবাদিক যোগ করেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হওয়ার সুফল নির্বাচনে পেতে যাচ্ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল। বিশেষ করে নতুন ভোটার এবং তরুণেরা স্বাভাবিকভাবেই গর্বিত যে তাদের আর কেউ এখন তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আখ্যা দিতে পারবে না, বলেন তিনি। ‘ক্ষমতাসীন দল ও তাদের জোটসঙ্গীদের জন্য এটা বড় একটা প্রাপ্য’।

বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন গত কয়েক বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলে চলা অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা অস্বীকার করতে পারবে না বিরোধীরা। বিরোধী দলগুলোর নেতাদের জোটবদ্ধ হওয়ার বর্তমান উন্মত্ত প্রচেষ্টা শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ বিরোধীদের একত্র করবার প্রচেষ্টা বলে মনে করা হচ্ছে। এক পর্যবেক্ষক বলেন, বেশি সময় দাবি করে নির্বাচন কমিশনে তাদের করা আবেদন শুধুমাত্র নিজেদের মতবিরোধ নিরসনের জন্য প্রয়োজন বলে ধরা হচ্ছে।

বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন স্টাবলিশমেন্ট তাদের মতামতকে দৃশ্যত সম্মান করে বিরোধীদের জন্য স্বল্প সময় বাড়িয়েছে। ডানপন্থী হোক বা বামপন্থী, ভারতের বেশিরভাগ বিশ্লেষক মনে করেন, ২০১৪ সালে করা বড় ভুল থেকে বেরিয়ে এসে বিরোধীরা নির্বাচনে অংশ নিয়ে ঠিক কাজ করেছেন। নির্বাচন বর্জন করে আর পার্লামেন্ট থেকে বাইরে থেকে তারা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে বড় কোনও গণতান্ত্রিক বিরোধীতা হাজির করতে পারেনি যা ব্যাপকভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে।

এর পরিবর্তে হেফাজতে ইসলামের মতো গোষ্ঠী রাজনৈতিক বিরোধীতার কট্টরপন্থী মনোভাব ধারণ করেছে। অস্বীকৃত হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রথাগত পরিসর ও প্রভাব। অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, বিএনপির ছেড়ে যাওয়া শূন্যস্থানই পূরণ করে গড়ে উঠেছে হেফাজত। আর তাদের এই শক্তিবৃদ্ধিতেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই তাদের শর্ত মানতে বাধ্য হয়েছে। কিছু জনপ্রিয় সমর্থন ছাড়া রাজনৈতিক সত্ত্বা হিসেবে হেফাজতের দ্রুত উত্থান কখনওই সম্ভব হতো না।

হেফাজতকে পাশে রাখার আওয়ামী লীগের এই এজেন্ডা নিয়ে শঙ্কায় বিজেপি সমর্থিত সংবাদমাধ্যম। হেফাজতে ইসলাম এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নতুন ৫০০ মাদ্রাসা স্থাপন ও তাদের সার্টিফিকেটকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের স্বীকৃতি দিতে করতে বাধ্য করেছে। প্রয়োজন পড়লে এসব কর্মসূচিতে সৌদি আরব অর্থায়ন করবে-আর সন্দেহ নেই এটি ইসলামপন্থীদের কাছে আরও সমধুর শোনাচ্ছে। এমন অবস্থায়, ‘৯০ শতাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নির্বাচনে লড়তে প্রধানমন্ত্রী কি করতে পারতেন?’, প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্মকর্তা। বাংলাদেশে ‘পাঠ্যসূচির ইসলামিকরণ’ও ভারতীয় ভাষ্যকারদের মনোযোগ কেড়েছে।

কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে বিএনপি’র এখন কী হবে? তার উত্তরসূরি তারেক রহমানও এখন লন্ডন থেকে ফিরতে অক্ষম। মনে হচ্ছে, বিএনপি শুধু আওয়ামী লীগের কাছেই হারেনি, বরং হেফাজতের কাছেও হেরেছে। নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ও দীর্ঘ শীতনিদ্রার ফল ভোগ করছে তারা। এসব কারণে আন্তর্জাতিক মিত্রদেরও সমর্থন হারিয়েছে তারা।

তবে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে আওয়ামী লীগকে এখনও সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপস একটি ছোটখাট সমস্যা। বৈশ্বিক উষ্ণতা, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মতো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে রফতানির প্রতিদ্বন্দ্বিতা বড় চ্যালেঞ্জ। বাণিজ্য যুদ্ধ আর বহুমাত্রিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বিস্তৃত হতে পারছে না বৈশ্বিক অর্থনীতি। সৌদি আরবের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ারও কিছু গোপন মূল্য আছে। রোহিঙ্গা ইস্যু এখনও অসামাপ্ত সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে এসব সমস্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা কীভাবে সামলান তা দেখার অপেক্ষায় সবাই।-বাংলাট্রিবিউনের সৌজন্যে প্রকাশিত।