ভারতে রাজ্যে রাজ্যে মূর্তি তোলার পাল্লা

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী, প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মূর্তিই স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে বড় অলঙ্কার। সেই থেকেই শুরু। তারপর গত ৭১ বছরে (১৯৪৭ থেকে) সারা ভারতে কম মূর্তি ওঠেনি।

সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মূর্তি উদ্বোধন করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দেশটির ‘লৌহমানব’ খ্যাত সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের ১৮২ মিটার আকাশচুম্বী মূর্তির নাম ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’।

এরপর থেকে কে কত উঁচুতে মাথা তুলতে পারে, সেই লড়াই এখন চরমে। ভারতের রাজনীতিতে জেঁকে বসেছে মূর্তির ভূত। পাল্লা দিয়ে উঠছে উঁচু উঁচু মূর্তি। মহারাষ্ট্র চাইছে মারাঠা সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছত্রপতি শিবাজির মূর্তি সবার উপরে মাথা তুলে দাঁড়াক।

অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে তো কম হইচই হল না। উত্তর প্রদেশও তাই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, ২২১ মিটারের বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি হবে রামের মূর্তি। রাজস্থানে ১৬৮ মিটারের সুউচ্চ শিবমূর্তির নির্মাণ কাজ চলমান। কর্নাটক রাজ্যও ১২৫ ফুটের কাবেরী মূর্তি তৈরির তোড়জোড় শুরু করেছে।

বিহারে সোমবার উন্মোচিত হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তি। গুজরাটের নর্মদা জেলার কেভাদিয়া এলাকায় প্যাটেলের ১৮২ মিটারের উঁচু মূর্তি দাঁড়িয়ে। ৩১ অক্টোবর প্যাটেলের জন্মদিনে মোদি প্রায় ৩ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত মূর্তিটি উন্মোচন করেন।

এটিই বর্তমানে বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি। প্যাটেলের মূর্তি নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে চরম বিতর্ক হয়েছে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ গ্রন্থে ভারত বিভাগের জন্য প্যাটেলকে দায়ী করেছেন। তিনি ছিলেন গান্ধীজির কাছের মানুষ।

সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় সত্যাগ্রহী নারীরা প্যাটেলকে ‘সরদার’ উপাধি দেন। তার এসব খ্যাতি ছাড়াও বিরোধী দলের দিকে ‘রাজনৈতিক তীর’ ছুড়তে প্যাটেলের মূর্তি তৈরি করেছে বিজেপি।

ক্ষমতায় বসার পর থেকেই ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস ও নেহেরু পরিবারের দীর্ঘদিনের আধিপত্য খর্ব করতে আদাজল খেয়ে নামেন মোদি।

নেহেরুর উদার ও সেক্যুলার মতের বিরোধিতাকারী প্যাটেলকে উপেক্ষিত ‘হিরো’ হিসেবে মনে করে বিজেপি। তার মূর্তি নির্মাণের অর্থ হল, প্যাটেলকে তার মাপের চেয়ে বড় করে দেখিয়ে নেহরুকে ছোট দেখানোর চেষ্টা। এছাড়া এ মূর্তি নির্মাণের কারণে জমিহারা ৭৫ হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছিলেন।

প্রতিবাদস্বরূপ, মূর্তি উন্মোচনের দিন আশপাশের ৭২টি গ্রামে চুলা জ্বলেনি। চীনের বুদ্ধমূর্তিকে টেক্কা দিতে মহারাষ্ট্রে মুম্বাই উপকূলে শিবাজির মূর্তি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

২১২ মিটার উচ্চতার এ মূর্তি তৈরিতে ব্যয় হবে প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি রুপি। ইতিমধ্যে ভারতের লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো কোম্পানির সঙ্গে তিন হাজার কোটি রুপির চুক্তি সম্পন্ন করেছে মহারাষ্ট্র সরকার।

চীনের স্প্রিং টেম্পলে বুদ্ধমূর্তির উচ্চতা ২০৮ মিটার। ২০২১ সালের মধ্যে শিবাজির মূর্তির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা প্রকল্প নথিতে উল্লেখ রয়েছে। তখন এটিই হবে বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি। গুজরাটের প্যাটেলের মূর্তি বা শিবাজির মূর্তিকে ছাড়িয়ে যাবে রাম মূর্তি।

গত শনিবার মন্ত্রিসভায় এ প্রকল্প পাস করেছে উত্তর প্রদেশের যোগী সরকার। অযোধ্যায় সরযূ নদীর তীরে নির্মিত হবে ২২১ মিটার উঁচু ব্রোঞ্চের এ মূর্তি। তবে ব্যয় বা কত সাল নাগাদ এর কাজ শেষ হবে তা নিশ্চিত করেনি যোগী সরকার। রাম মন্দির নির্মাণ নিয়ে শিবসেনা ও হিন্দু পরিষদ মোদি সরকারকে চাপ দিচ্ছে। এটা স্পষ্ট যে, চাপের মুখে তড়িঘড়ি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মোদিঘনিষ্ঠ যোগী। বিশ্বের উচ্চতম মূর্তি হবে এটি।

রাজস্থানে ১৬৮ মিটারের সুউচ্চ শিবমূর্তির নির্মাণ কাজ চলমান। ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যে রাজস্থানের নাথদ্বারার গণেশ টেকরিতে নির্মিতব্য মূর্তিটির কাজ শেষ হবে। ২০১২ সালে শিলান্যাস হওয়া এ মূর্তির কাজ ইতিমধ্যে ৮৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। নির্মাণ সম্পন্ন হলে এটি হবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শিবমূর্তি। পাশাপাশি এটিই বিশ্বের চতুর্থ উচ্চতম মূর্তি।

মূর্তি গড়ার দৌড়ে শামিল হয়েছে কর্নাটকও। বেঙ্গালুরু থেকে ৯০ কিমি. দূরে মান্ডিয়া জেলার কৃষ্ণ রাজা সাগর জলাধারে তৈরি হবে কাবেরী মাতার ১২৫ ফুট উচ্চতার মূর্তি। ৪০০ একর জমির ওপর এ মূর্তি তৈরিতে আনুমানিক ব্যয় হবে এক হাজার ২০০ কোটি রুপি।

২০২১ সালের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন কর্নাটকের জলসম্পদমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার। সোমবার ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তি উন্মোচন করেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। ৭০ ফুট উঁচু বুদ্ধদেবের মূর্তিটি নালন্দা জেলার রাজগিরের গোরা কাটোরা লেকের মাঝখানে তৈরি হয়েছে। ৪৫ হাজার কিউবিক ফুটের গোলাপি পাথরের মূর্তিটি তৈরির খরচ প্রায় ২০ কোটি রুপি।

তবে বাজেট থেকে এসব অর্থের খুব কমই এসেছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ব্রিটেনের কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থ সাহায্য নিয়েছেন মোদি। সে অর্থই মূর্তি নির্মাণে ঢালছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন ব্রিটিশ এমপি পিটার বোন। প্যাটেলের মূর্তি নির্মাণের পর ব্রিটিশ গণমাধ্যমে এ খবর ফলাও করে ছাপা হয়েছিল।