ভারত থেকে কেন বাংলাদেশে গরু পাচার?

ভারতীয় সীমান্তে গরু পাচার রোধে দিন দিন কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পরও তা বন্ধ হচ্ছে না। কৌশল পরিবর্তন করে গরু পাচারকারীরা তাদের কাজ অব্যাহতই রেখেছে। সীমান্ত দিয়ে অবাধে ঢুকছে গরু আর মহিষ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুই দেশের সীমান্তের মানুষ কেন গরু পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন তার ব্যাখ্যা দিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দি হিন্দুস্থান টাইমস।

বাংলাদেশ ও ভারতে রয়েছে ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রেখা। এরমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে রয়েছে কয়েকটি সীমান্ত পথ। তবে রাতের আঁধারে চোরাচালানকারীরা সেসব পথ ব্যবহার করে না। তারা নিজেরাই গোপনে কিছু পথ তৈরি করে নেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গরু পাচারে লাভ বেশি হওয়ায় সীমান্তের মানুষ জীবনের ঝুঁকি থাকলেও এই পেশা ত্যাগ করতে পারেন না। তাদের হিসেবে ভারতে যে গরু বা মহিষের দাম ৫ হাজার টাকা, সেটাই বাংলাদেশে বিক্রি হয় ৫০ হাজারে। ফলে ১০ গুণ লাভের আশায় অনেকেই চোরাচালানের পথ ত্যাগ করেন না।

ভারতীয় পুলিশের এক সুত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই দশক আগেও সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পালে পালে গরু পাচার করা হত। এবং খুব দ্রুতই তা সম্পন্ন হত। এজন্যে পাচারকারীরা গরুর যোনিতে মরিচ কিংবা পেট্রোল ব্যবহার করত। যাতে যন্ত্রণায় গরু না হেঁটে বরং দৌঁড়ে সীমান্ত অতিক্রম করে। ফলে খুব কম সময়ের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০টি গরু ভারতীয় সীমান্তের কাঁটাতারের ফাঁক গলে বাংলাদেশে প্রবেশ করত।

এই পন্থায় সব গরু যে সীমান্ত পাড়ি দিতে পারত তা নয়, কাঁটাতারে জড়িয়ে কিছু গরুর যাত্রা সেখানেই শেষ হয়ে যেত। তবে অধিকাংশ গরু পাচার হয়ে যেত বলে মন্দের উপর ওই পন্থাটি চালুই ছিল। অবশ্য সীমান্তে নিরাপত্তা কঠোর করায় এবং কাঁটাতারের বেড়া সংস্কার ও কড়া নজরদারি রাখায় বর্তমানে সেই কৌশলে আর কাজ হচ্ছে না। ফলে পাচারকারীরা নিয়েছে নতুন কৌশল।

ভারতীয় সীমান্তে থাকা অধিকাংশ গরু পাচারকারী অমুসলিম বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে হিন্দুস্থান টাইমস। গরু পাচারের জন্য এখনও যেসব সীমান্ত বেশি ব্যবহার হয় তার মধ্যে অন্যতম আসাম, মেঘালয় আর বাংলাদেশের ত্রিমুখী সীমান্ত। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে স্থল সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দ্বিগুণ করায় পাচারকারীরা এখন অন্যপথ নিয়েছে। আর সেটি হল নদী পথ…

পাচারকারীরা নদীপথে গরু বাংলাদেশে নিয়ে আসে। এজন্যে নদীতে গরু ভাসিয়ে পাচারকারীরা ডুব সাঁতার দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে। বিএসএফ কিংবা বিজিবি যাতে তাদের না দেখতে পায় এজন্যে পাইপ বা চোঙ্গা দিয়ে নদীর তলদেশ থেকে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে থাকে। আর এভাবে অদৃশ্য অবস্থায় তারা গরুর পাল নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়। তবে ভয়াবহ ব্যাপার হল, এই বিপদজনক কাজে যাদের ব্যবহার করা হয় তাদের বেশিরভাগই শিশু।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাই স্থল ছাড়াও সীমান্তের নদীপথগুলোতে নজরদারি বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। নদীতে ট্রলার দিয়ে টহল বৃদ্ধি তো রয়েছেই, পাশাপাশি নাইটভিশন ক্যামেরা ও দূরবীন দিয়ে প্রতিটি স্থান নজরে রাখছে বিএসএফ। বসানো হচ্ছে লেজার সুবিধাও। অবশ্য রাতে নজর বৃদ্ধির ব্যবস্থা স্থল সীমান্তেও প্রয়োগ করা হয়েছে।

তা সত্ত্বেও থেমে নেই চোরাকারবারিদের কাজ! স্থল পথে কাঁটাতারের বেড়া মজবুত হওয়ায় তার উপর দিয়েই গরু আনা-নেয়া হচ্ছে। এজন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ বাঁশ ব্যবস্থা। বাঁশের কপিকলের মাধ্যমে অত্যন্ত নির্দয় উপায়ে অর্থলোভীরা গরুগুলোকে পাচার করে থাকে।

আর নদীপথে নতুন কৌশল হিসেবে দু’টি কলাগাছ গরুর সঙ্গে বেঁধে তারপর ভাসিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করানো হয়। প্রথমে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় ঝোপজঙ্গল আর আবর্জনা। তারপর কলার ভেলার সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয় গরুকে। শুধু মুখ পানির উপরে রেখে ভাসিয়ে দেওয়া হয় কালজানি নদীতে। আবর্জনার ভিড়ে লুকিয়ে গরু ভেসে আসে বাংলাদেশে। ওপার থেকে তা তুলে নেয় চোরাকারবারিরা। চিহ্ন দেখে কার গরু তা বোঝা যায়।

সম্প্রতি পুলিশের এক সোর্স গোপনে এই পন্থার ভিডিও করে তা প্রকাশ করলে নিরাপত্তা বাহিনীর বিষয়টি জানা হয়ে যায়। আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী কালজানি নদীতে এভাবেই গরু পাচার হচ্ছিল। বিষয়টি টের পেয়ে আশরাফুল আকন্দ নামের এক শীর্ষ চোরাকারবারিকে গ্রেফতারও করেছে আসাম পুলিশ।

বিএসএফ বলছে, শুধু সীমান্তে চোরাচালান একমাত্র সমস্যা নয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে সীমান্তে জড়ো করা হয় গরু ও মহিষ। যার প্রায় সবই পাচারের উদ্দেশ্যে। বিষয়টি জানা থাকা সত্ত্বেও বাহিনীর কিছু করার থাকে না। কেননা, সীমান্তে চোরাচালানে আইন কঠোর করা হলেও ভারতের মধ্যে গরু স্থানান্তরের বিষয়ে কোনো আইন নেই। তাই বিভিন্ন রাজ্য থেকে গরু এনে সীমান্তে জড়ো করা হলেও তারা নিরুপায়।