ভারত-বাংলাদেশ একটি পরিবার : নরেন্দ্র মোদি

ভারত-বাংলাদেশ একটি পরিবার উল্লেখ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ভৌগোলিক দিক থেকে আমরা (দু-দেশ) প্রতিবেশী দেশ হলেও ভাবনার দিক থেকে আমরা এক পরিবার। একে অপরের সুখ দুঃখে সঙ্গ দেয়া, একে অপরের ভালো কাজে হাত লাগানো একটি পারিবারিক মূল্যবোধ। দুই দেশের এই সম্পর্ক আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধেরই অংশ।

মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনটি নির্মাণ প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

মোদি বলেন, কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের দু-দেশের সম্পর্ক বিশ্বকে নতুন কিছু দেখিয়েছে। বিশ্ব দেখেছে দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক ভালো হলে কত কিছুই না করা সম্ভব। এটা হোক দীর্ঘ সময়, পুরোনো সীমান্ত বিরোধ নিস্পত্তি কিংবা অগ্রগতির জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের অংশিদারিত্ব। দুই দেশের মধ্যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এই অগ্রগতির কৃতিত্ব আপনার (শেখ হাসিনা) নেতৃত্বকে দিতে চাই। এ জন্য আপনাকে অভিনন্দনও জানাই।

তিনি বলেন, কিছু দিনের ব্যবধানে আমরা আবারও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মিলিত হলাম। আমাদের ভিডিও কনফারেন্সের কারণ শুধু প্রযুক্তিগত সহায়তা নয়, এর পেছনে ভারত ও বাংলাদেশে সম্পর্কের অবাধ গতি ও নির্বার প্রগতির বিষয়। আজ ভারত বাংলাদেশের মধ্যে মৈত্রী পাইপলাইনের কাজ শুরু হয়েছে। প্রগতির জন্য দুই দেশের অগ্রগতির মাইলফলক হিসেবে এই মহান কর্মযজ্ঞ যুক্ত হলো। এটা নতুন অধ্যায় করলো।

নির্মিতব্য পাইপলাইন বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের কাছে হস্তান্তর করা হবে জানিয়ে এই বিজেপি নেতা আরও বলেন, যে কোনো দেশের বিকাশের জন্য একটি মহান উদ্যোগ জরুরি। আমি মনে করি- আজকের এই মৈত্রী পাইপলাইনের মহান উদ্যোগ বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ লক্ষ্যপূরণে বড় ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এই পাইপলাইন সস্তা দামে জ্বালানি সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের অর্থ ব্যবস্থার মধ্যেও পাইপলাইন স্থাপন করবে। এই পাইপলাইন ভারতের অনুদানের অর্থ থেকে বানানো হচ্ছে। কিন্তু আমাদের জন্য আশার বিষয় হলো- কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর এই পাইপলাইন বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

কানেকটিভিটি নিয়ে নরেদ্র মোদি জানান, একইভাবে আমরা রেলওয়ে প্রজেক্টের কাজ শুরু করেছি- এটা ঢাকার সাধারণ মানুষ বা ট্রাফিক ব্যবস্থাকে শুধু আরামই দেবে না- এমনকি প্রবৃদ্ধিও বাড়াবে। আমার বিশ্বাস এই রেলওয়ে প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও শহরের ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাকে সংস্কার করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

মাত্র ৮ দিনের মধ্যে আমরা ভিডিও কনফারেন্সে মাধ্যমে-৫ প্রকল্পের শুভ সূচনা করেছি জানিয়ে হাসিনার প্রশংসা করে তিনি আরও বলেন, ’এই গতি – এই মুমেন্টাম আপনার মজবুত ও কৌশলী নেতৃত্ব ছাড়া সম্ভব হতো না। আমার বিশ্বাস- ভারত ও বাংলাদেশে জনসাধারণের উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য আমরা এভাবেই ভালো চিন্তা করতে থাকবো।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদিকে তার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে মোদি বলেন, আপনি আমার জন্ম দিনের শুভেচ্ছ ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। এ জন্য আমি আপনার ও বাংলাদেশি জনগণের মঙ্গল কামনা করি ও ধন্যবাদ জানাই। আর বক্তব্য শেষ করার আগে ’আপনার ২৮ সেপ্টেম্বরের জন্মদিনের অগ্রিম শুভেচ্ছ জানাই। শুভ জন্মদিন’।

ভিডিও কনফারেন্সে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নেয়া যৌথ প্রকল্পগুলো বাংলাদেশকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে নেবে। উভয় দেশ মিলে যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে, তা দুই দেশের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

শেখ হাসিনা বলেন, ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এবং পাইপলাইন দিয়ে সরবরাহ চালু হয়ে গেলে জ্বালানির দাম অনেক কমে যাবে।

‘ঢাকা-টঙ্গী ও টঙ্গী-জয়দেবপুর তৃতীয়-চতুর্থ এবং পঞ্চম ডুয়েল-গেজ রেললাইন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হলে এক দিকে যেমন ঢাকার ওপর চাপ কমবে তেমনি যাতায়াতের গতি বাড়বে। এতে ভারত-বাংলাদেশ উভয়েই উপকৃত হবে,’- বলেন তিনি।

বাংলাদেশ সরকারপ্রধান বলেন, প্রকল্পের আওতায় ৯৬ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ হলে বাংলাদেশের পণ্য যেমন চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে ভারতসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় যেতে পারবে তেমনি উত্তরপূর্বে ভারতের রাজ্যগুলোয় সরবরাহ করা যাবে।

আজ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প ছাড়া বাকি দুটি হলো- ভারতীয় এলওসির অর্থায়নে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প।

প্রকল্প উদ্বোধনের সময় ভিডিও কনফারেন্সে দু’দেশের প্রধানন্ত্রীর কার্যালয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিতি ছিলেন।

ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মিত হলে সমন্বতি ও গতিময় ট্রেন সার্ভিস প্রবর্তনের মাধ্যমে শহরতলী এবং অন্যান্য জেলাগুলোর যাত্রী সাধারণের রাজধানী ঢাকায় স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও সময়সাশ্রয়ী যাতায়াত সম্ভব হবে।

প্রকল্পটিতে ভারতীয় এলওসি’র বরাদ্দ ৯০২ কোটি ৬৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা। অপরদিকে বাংলাদেশ সরকার খরচ করবে ২০৪ কোটি ১৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।

যাত্রী সাধারণের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিকসংখ্যক ট্রেন চালু করার লক্ষ্যে ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবললাইন নির্মাণ প্রকল্পের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

এ প্রকল্পে নির্মিতব্য অবকাঠামোগুলো রাজধানী ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, টঙ্গী-জয়দেবপুর হয়ে উত্তরাঞ্চল এবং চট্টগ্রাম ও সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও গতিময় করার ক্ষেত্রে ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর ফিডার সেকশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ভারতীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এফকন্স-কল্পতরু যৌথভাবে কাজটি করবে। চুক্তির মেয়াদ কাজ শুরুর তারিখ হতে ৩৬ মাস। এতে এমব্যাংকমেন্টসহ ৯৬ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মিত হবে। এ ছাড়া কালভার্ট ২৫টি, প্লাটফর্ম ৬, প্লাটফর্ম সেড ৬, ফুটওভার ব্রিজ ১২, স্টেশন বিল্ডিং ৪টি এবং অন্যান্য পূর্ত কাজ করা হবে।

বর্তমানে আমদানিকৃত তেল চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ হতে খালাস করে চট্টগ্রাম ডিপোতে সঞ্চয় করে রাখা হয়। পরে কোস্টাল ট্যাংকে করে খুলনার দৌলতপুর ডিপোতে আনা হয়। সেখানে আনলোড করে আবার রেলের ওয়াগনে আপলোড করে নিয়ে যাওয়া হয় পার্বতীপুরে।

এই প্রক্রিয়ায়, পরিবহনজনিত সমস্যা, অতিরিক্ত সময় এবং অর্থের অপচয় হয় উল্লেখ করে তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, পাইনলাইনের মাধ্যমে তেল আনলে এ তিনটারই সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া, জ্বালানি নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে এ পাইপলাইন কার্যকর অবদান রাখবে।

পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আমদানি সংক্রান্ত ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি গত বছরের ২২ অক্টোবর স্বাক্ষরের পরে চলতি বছরের ৯ এপ্রিলে সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর করা হয়। এ পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রথম তিন বছর ২ দশমিক ৫ লাখ টন ডিজেল সরবরাহ করা হবে। পর্যায়ক্রমে এ সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে শেষ পাঁচ বছর ৪ লাখ টনে উন্নীত করা হবে। বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে প্রয়োজনে জ্বালানি তেলের আমদানি এই পাইপলাইনের মাধ্যমে আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। নুমালীগড় রিফাইনারি ওই পাইপলাইনের মাধ্যমে ১৫ বছরের জন্য ডিজেল সরবরাহ করবে। উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে এ সময় বর্ধিত করা হবে।

ভারতের শিলিগুড়ি হতে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইনে চলতি বছরের আগস্ট-ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার টন ডিজেল ভারত হতে রেল ওয়াগনের মাধ্যমে আমদানি করা হবে আশা করা হচ্ছে।

এর আগে গত ১০ সেপ্টেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের দুই প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যৌথভাবে আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েল গেজ রেল লাইন নির্মাণ কাজ, কুলাউড়া-শাহবাজপুর বিভাগের রেলপথের সংস্কার প্রকল্প এবং বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে ভারত থেকে ভেড়ামারায় নবনির্মিত ৫শ মেগাওয়াট এইচভিডিসি ব্যাক টু ব্যাক কেন্দ্রের দ্বিতীয় বন্টকের উদ্বোধন করেন।