ভারী বর্ষণে চরম বিপাকে রোহিঙ্গারা, ক্ষতিগ্রস্ত ৩ হাজার ঘর

টানা পাঁচদিনের বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়ার কারণে রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের নাগরিকরা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় সঙ্কটে পড়েছে। আর এর ফলে উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা তাদের আশ্রয়স্থল হারিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘর। নিহত হয়েছেন শিশুসহ দুই জন রোহিঙ্গা।

মঙ্গলবার (৯ জুলাই) এক ইমেইল বার্তায় এসব তথ্য জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম।

ক্যাম্প জুড়ে কর্মরত আইওএম’র কর্মকর্তা এবং স্বেচ্ছাসেবকেরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরেজমিনে গিয়ে এ ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করেন বলে বার্তায় জানানো হয়েছে। আইওএম ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প জুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত আবাসস্থলগুলো মেরামত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে জরুরি আশ্রয়স্থলে নিতে কাজ করে যাচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে আইওএম’র মুখপাত্র জর্জ ম্যাকলয়েড বলেছেন, বর্ষাকালের মাত্র অর্ধেক সময় পার হয়েছে। এরই মধ্যে গত ৭২ ঘণ্টায় আমরা দুই হাজার মানুষকে সহায়তা করেছি। আমাদের সব সদস্য সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

আইওএম এর এই কর্মকর্তা ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক পরিমাণ ২০১৮ সালের ক্ষয়ক্ষতির থেকেও বেশি হয়েছে বলে উল্লেখ করে জানিয়েছেন, গত ৩ থেকে ৫ জুলাই, এই তিনদিনে সবচেয়ে বড় কুতুপালং মেঘা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৫১০ মিলিমিটার। আরেকটি বড় ক্যাম্প- ‘ক্যাম্প ১৬’তে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৫৩০ মিলিমিটার।

এদিকে ভারী বৃষ্টিতে বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়া নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবির পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে দুর্ভোগে পড়েছে এখানে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১ হাজার ৩০০ রোহিঙ্গা পরিবারের পাঁচ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু। দেখা দিয়েছে খাবার ও পানি সঙ্কট।

বিষয়টি নিয়ে তুমব্রু শূন্যরেখা রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, “প্রবল বৃষ্টির পানির সাথে পাহাড়ি ঢল নেমে আসায় এখানকার শিবিরটি প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পানিতে তলিয়ে রয়েছে। বর্তমানে এখানে খাদ্য এবং খাবার পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শিশুরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।”

এ বিষয়ে জাদিমুড়া শালবন পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রিত মোহাম্মদ আবু তাহের বলেন, “শনিবার রাত থেকে ভারী বর্ষণে পাহাড়ি ঢলের পানি ঘরে ঢুকে পড়ে। এতে পরিবারের ৮ সদস্যর রাতে নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে। ভূমিধসের ভয়ে পাহাড়ের পাদদেশের ঝুপড়ি ঘর ফেলে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজছি।”

অন্যদিকে, জাদিমুড়া রাস্তার পাশের রোহিঙ্গা শিবিরের মাঝি মোহাম্মদ একরাম বলেন, “কদিনের ভারী বৃষ্টিপাতে অনেকের বাড়ির ঘরের ত্রিপলের ছাউনি নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানিতে ঘর ভিজে যায়। ফলে সন্তানদের নিয়ে বসে বসেই কাটাতে হয়।”

বিষয়টি নিয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল হাসান বলেন, “রোহিঙ্গারা পাহাড় ও বন কেটে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করেছে, তাই ঝুঁকিটা বেশি। তবে ভারী বর্ষণে দুর্ঘটনা এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রোহিঙ্গা সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। আশপাশের মসজিদ, সাইক্লোন শেল্টার, আশপাশের স্কুলের ভবন প্রস্তুত রাখা হয়েছে।”

আইওএমের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার তারেক মাহমুদ প্রেরিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, পাঁচদিনের ভারি বর্ষণ এবং ঝড়ো হাওয়ায় উখিয়া-টেকনাফে ভূমিধসে ১ হাজার ১৮৬টি, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২১৬টি এবং ঝড়ো হাওয়ায় ১ হাজার ৮৪০টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ১৫ হাজার ৫৩৪ জন রোহিঙ্গা। এছাড়াও ক্যাম্পগুলোতে ৩৯১টি ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে এবং ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে ৫১ বার।

পুরো চলতি সপ্তাহজুড়ে বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়া অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানায় আইওএম। পাহাড় ধসে মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হওয়ার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে প্রশাসন। শনিবার থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ভারী বর্ষণ শুরু হওয়ায় দুর্ঘটনা এড়াতে গত শনিবার থেকে তাৎক্ষণিক ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের সরিয়ে অন্য আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। কত সংখ্যক রোহিঙ্গা ভূমি ধসের ঝুঁকিতে আছে এবং কতজনকে সরানো হয়েছে সেটি তালিকা শেষে বলা যাবে। আপাতত যারা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, দ্রুত সরানোর প্রক্রিয়া চলছে।

আবুল কালাম জানান, পাহাড়ি এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বসবাস গড়ে ওঠায় ভারী বর্ষণে সেখানে ভূমি ধসের কিছুটা ঝুঁকি রয়েছে। তবে এই বর্ষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।