ভারী বর্ষণে ভাসছে চট্টগ্রাম

আষাঢ় মাস আসতে আরো দুই দিন বাকি। তার আগেই ভারী বর্ষণে ভেসে গেছে চট্টগ্রাম। কোমরসমান পানিতে ডুবেছে নগরীর বিভিন্ন এলাকা। রোববার রাত থেকে টানা বর্ষণে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পানিবন্দি এলাকার লোকজনকে। যানবাহন সঙ্কটে রাতে ঈদ শপিং করতে যাওয়া হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘ সময় আটকা পড়েছিল বিভিন্ন মার্কেটে। তবে আশঙ্কা সত্ত্বেও গতকাল পর্যন্ত কোনো ধরনের পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেনি।

সোমবার (১১ জুন) দুপুর ১২টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ২৩১ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। পঞ্জিকার হিসাবে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষেই পুরোপুরি বর্ষার আমেজ এনে দিয়েছে দুই দিনের টানা বর্ষণ। আর এই বর্ষণে বরাবরের মতো এবারো জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে চট্টগ্রাম নগরবাসী। পানিবন্দি হয়ে পড়ায় অনেক এলাকার লোকজন দৈনন্দিন কাজের জন্য ঘরের বাইরে বের হতে পারছে না।

রোববার রাত ও গতকাল সোমবার সকালের ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে নগরীর নিচু এলাকাগুলো। বিশেষ করে বাকলিয়া, হালিশহর, আগ্রাবাদ, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, ষোলশহর, পাঁচলাইশ, নাসিরাবাদ, প্রবর্তক মোড়, বাদুড়তলাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষকে কোমরপানিতে বন্দি থাকতে হয়েছে দীর্ঘসময়। এসব এলাকার নিচতলায় পানি ওঠার কারণে এখানকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। রোববার রাতে অনেক বাসায় চুলা জ্বালানোর সুযোগ না থাকায় সাহরিও রান্না হয়নি। নগরীর বাদুড়তলা এলাকার বাসিন্দা মো. সেলিম জানান, বর্ষা শুরুর আগেই বর্ষার স্বাদ পেয়ে গেছি আমরা। গত কয়েক বছরের মতো এবারো বাদুড়তলা এলাকায় নিচতলার বাসাবাড়িতে পানি ঢুকেছে। নষ্ট হয়ে গেছে মূল্যবান জিনিসপত্র। অনেক বাসার মানুষকে সারা রাত পানিতে নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে।

ভারী বর্ষণে নগরীর বিভিন্ন এলাকার সড়কগুলোও পানির নিচে তলিয়ে যায়। এসব সড়কে পানিতে আটকা পড়ে শত শত গাড়ি। আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের ওপরও এ সময় প্রচুর যানবাহন জ্যামে আটকা পড়ে। এর ফলে যাত্রীদের পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। জলাবদ্ধতাকবলিত এলাকা ছাড়াও অন্যান্য এলাকায়ও এ সময় যানবাহনের সঙ্কট দেখা দেয়। গাড়ি না পেয়ে অনেককে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে পায়ে হেঁটে ফিরতে হয়েছে বাসাবাড়ি। এ সুযোগে রিকশা ও অটোরিকশা চালকরা মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া হাতিয়ে নেয় যাত্রীদের কাছ থেকে।

গভীর রাতে ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতার কবলে পড়া লোকজনকে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের দুর্ভোগের অবস্থা ও ক্ষোভ জানাতে দেখা যায়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর ও খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক জামাল হোসেন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ‘মেগা ভোগান্তি, মেগা দুর্ভোগ-জলাবদ্ধ চট্টগ্রাম’।

রোববার রাত ১২টায় পানিতে গাড়ি নিয়ে আটকা পড়া খোরশেদ আলমদার নামে একজন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বহদ্দারহাট অভিমুখে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের উপরে এক ঘণ্টা জ্যামে আটকে আছি। কখন আল্লাহ গুনাহ মাফ করবেন জানি না।’

ভারী বর্ষণ ও জলাবদ্ধতায় রোববার মধ্যরাতে নগরীর বিপণি কেন্দ্রগুলোতে আটকা পড়ে শত শত মানুষ। রমজানের শেষ দিকে এসে এখন মানুষ ঈদবাজারের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বিভিন্ন মার্কেটে। রাতদিন সমানে মার্কেটগুলোতে ভিড় জমছে ক্রেতাদের। রোববার রাতের ভারী বর্ষণে নগরীতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে বিভিন্ন মার্কেটে বাজার করতে যাওয়া লোকজন আটকা পড়ে যায়। বাসাবাড়িতে যাওয়ার রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই বাসায় ফিরতে পারছিল না। আবার সড়কগুলোতে পানি ওঠায় যানবাহনের জ্যাম লেগে বাসায় ফেরার জন্য গাড়িও মিলছিল না। এ অবস্থায় অনেককে পানি মাড়িয়েই ভেজা কাপড়ে বাসায় ফিরতে দেখা যায়।

এদিকে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ব্যাহত হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস। ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) সূত্র জানায়, ভারী বর্ষণ ও সাগর উত্তাল থাকায় বহির্নোঙরে মাদার ভেসেলের পাশে লাইটারেজ জাহাজগুলোর অবস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে গতকাল কোনো লাইটারেজ জাহাজ বহির্নোঙরে যায়নি। বন্দর সূত্র জানায়, বহির্নোঙরে অবস্থানরত ৯১টি মাদার ভেসেলের মধ্যে ৮১টিতেই কোনো কাজ হচ্ছে না। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ২৯টি কন্টেইনার জাহাজ, ১৩টি সাধারণ পণ্য, ৮টি খাদ্যশস্যবাহী, ২০টি সিমেন্ট ক্লিঙ্কার, ৩টি চিনিবাহী ও ৯টি অয়েল ট্যাঙ্কার। চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে বহির্নোঙরে পণ্য খালাস ব্যাহত হলেও জেটিতে কন্টেইনার ওঠানামার কাজ স্বাভাবিক রয়েছে।

সীতাকুণ্ড উপকূল অতিক্রম করেছে নিম্নচাপ : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূল অতিক্রম করেছে চলতি মৌসুমের প্রথম নিম্নচাপ। রোববার রাতেই এটি উপকূল অতিক্রমের পর দুর্বল হয়ে লঘুচাপে পরিণত হয়। আবহাওয়া অধিদফতর সূত্র জানায়, উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি ঘনীভূত ও মৌসুমি নিম্নচাপে পরিণত হয়ে রোববার রাত ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডের কাছ দিয়ে চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করে এবং দুর্বল হয়ে কুমিল্লা ও ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলে লঘুচাপরূপে অবস্থান করছে।

এটি আরো উত্তর/উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে। মৌসুমি বায়ু উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে এবং গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালার সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমা মৌসুমি বায়ু চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিভাগে বিস্তার লাভ করেছে। আবহাওয়ায় এক ভারী বর্ষণের সতর্কবাণীর পূর্বাভাসে বলা হয়, গতকাল সোমবার বেলা ১১টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও দমকা-ঝড়ো হাওয়াসহ ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে।