ভালোবাসা ভালো নেই || সাবিনা ইয়াসমিন

আজ মিথিলা ও মাসুমের বিবাহ বার্ষিকী।
মিথিলা বেলকুনির রেলিং ধরে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। ভাবছে জীবনের হারিয়ে যাওয়া অতীতের কথা। সুখের কথা দুঃখের কথা।
মিথিলা বড় লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। বাবা মায়ের বড় আদরের মেয়ে ছিল।
ছিল কলিজার টুকরোও।
মিথিলার বাবা মা মিথিলাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। লেখাপড়া করে একদিন অনেক বড় হবে। বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে।
কিন্তু মিথিলা তাদের স্বপ্ন নিমিষে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
বড় স্বার্থপর মেয়েটা বাবা মাকে একা করে শুধু নিজের সুখের কথা ভেবেছে।
মিথিলার বাবা যেদিন। মিথিলা আর মাসুমকে এক সঙ্গে রেস্টুরেন্টে খেতে দেখল, সেই দিন মিথিলার বাবা অফিস থেকে বাসায় ফিরে মিথিলাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল কে ছেলেটি।
মিথিলা অবাক হয়ে বলল কোন ছেলেটি আব্বু ?
ওই যে রেস্টুরেন্ট তোমার সঙ্গে ছিল।
মিথিলা মাথানিচু করে বলল ওর নাম মাসুম।
ওই ছেলের সাথে তোমার কি সম্পর্ক।
আমি মাসুমকে ভালোবাসি।
কি করে ও?
জব।
সেলারি কত।
৩০ হাজার।
সংসারে কে কে আছে ও।
বাবা মা ছোট ভাই ছোট বোন।
মাসুমের বাবা কি করে ?
সরকারি চাকরি অবসর প্রাপ্ত।
এত কম সেলারিতে মাসুমের সংসার চলে কি করে।
হয়তো টেনেটুনে যায় এক রকম।
মিথিলা জীবন বড় কঠিন মাসুমের সংসারে তুমি এক মুহূর্ত সুখী হতে পারবে না, আমি আমার বন্ধুর ছেলে আহাতের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছি আগামী মাসের এক তারিখে তোমাদের বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলেছি। আহাত বড় একটা কোম্পানিতে জব করছে সেলারি ভালো।
দেখতেও বেশ স্মার্ট, ভদ্র তুমি ওখানে সুখেই থাকবে, বিয়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করো, আর মাসুমকে ভুলে যেও, সেটিই সব চেয়ে ভালো হবে।
আমি যেন আর কোনো দিন তোমাকে মাসুমের সঙ্গে না দেখি।
মিথিলার আম্মু তুমি মেয়েকে ভালো করে বুঝাও। এমন ছেলে হাত ছাড়া হলে আর পাওয়া যাবে না, আমি এক কথার মানুষ যা বলি তাই করি।
রেবেকা স্বামীকে বললেন তুমি রুমে যাও, ফ্রেস হয়ে নাও, আমি মিথিলাকে বুঝিয়ে বলছি।
মিথিলার আব্বু রুমে চলে গেলে।
রেবেকা বলল মিথিলা তুমি তো তোমার আব্বুকে চেনো এক কথার মানুষ, ও কখনোই তোমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না।
তারচেয়ে ভালো হবে তুমি মাসুমকে ভুলে যাও।
মিথিলা বলল না আম্মু, আমি মাসুমকে ছাড়া বাঁচব না, ভুলতে পারব না। অনেক ভালোবাসি ওকে। ও আমাকেও অনেক ভালোবাসে।
রেবেকা মেয়েকে অনেক বুঝালেন। কিন্তু মিথিলা কিছুতেই শুনলো না।
পরের দিন মিজান আহমেদ মেয়ের হাত থেকে মোবাইলটি নিয়ে নিলো।
মিথিলার কলেজ এক মাসের জন্য বন্ধ।
তাই মিজান আহমেদের অনেক সুবিধা হয়েছে। কোনো কারণ ছাড়া মেয়েকে বাসার বাইরে তিনি যেতে দেন না, যদিও বা কোনো কিছুর প্রয়োজনে যায়, কাজের মেয়েকে সঙ্গে নিতে হয়।
এভাবে চলে গেল কয়েক দিন।
মিথিলা রুমে গৃহবন্দী মাসুম এ ব্যাপারে কিছুই জানে না, ফোনে অনেক বার ট্রাই করেছে কিন্তু ফোন অফ।
মাসুম অফিসের একটা কাজে
মিথিলার বাসার সামন দিয়ে যাওয়ার পথে ওদের কাজের মেয়ে চুমকির সাথে দেখা হলে, মাসুম মিথিলার কথা জিজ্ঞাস করতেই সবকিছু খুলে বলল চুমকি।
আপামণি আপনার সাথে দেখা করে বলে খুলু আপামণিরে ঘরে বন্দী কইরা রাখছে মোবাইলটা কাইরা নিছে।
সব শুনে মাসুম একটা চিঠি লিখে চুমকিকে বলল এটা মিথিলাকে দেবে।
চুমকি তাড়তাড়ি গিয়ে চিঠিটা মিথিলাকে দিল।
মাসুমের চিঠি পেয়ে মিথিলা খুব খুশি, তাড়াতাড়ি চিঠি খুলে পড়ে সে। চিঠিতে লেখা রাতে দেখা হবে, আমি আসবো।
রাত ১২ টা বাজলে মিথিলা জানালার দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখে মাসুম। হাত দিয়ে ইশারা করলো মাসুম। মিথিলা তা দেখে দ্রুত নিচে নেমে এসে মাসুমকে জড়িয়ে ধরে বলল তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো, আমি আর পারছি না আমার দম বন্ধ হয়ে আচ্ছে। আমি এভাবে আর কিছু দিন থাকলে মরে যাব।
মাসুম মিথিলাকে বুকে শক্ত করে ধরে বলল,
পাগলি আমার। যাবই তো, আমার বউ করে নিয়ে।
তুমি আমার একান্তই শুধু আমার,
আমার থেকে কেউ তোমাকে আলাদা করতে পারবে না।
মিথিলা বলল আমি ওতো সতো বুঝিনা, তুমি আমাকে ওখান থেকে নিয়ে যাবে কি না বলো।
মাসুম বলল কাল দুপুর দুটায় রেস্টুরেন্ট এসো।
আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
হঠাৎ মিথিলার আব্বুর রুমটা আলোকিত দেখে মিথিলা মাসুমের বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত রুমে যাবে, এমন সময় মাসুম পিছন থেকে মিথিলার হাত টেনে ধরে বুকে জড়িয়ে বলল যাবেই তো এত তারা কিসের।
মিথিলা বলল মনে হয় আব্বু জেগে আছে। টের পেলে দুজনকেই মেরে ফেলবে।
মাসুম বলল কাল আসছো তো ?
মিথিলা বলল অবশ্যই আসবো, এবার তুমি যাও।
পরের দিন দুটায় মিথিলা ওর আম্মুকে বলল আম্মু, আমার কিছু কসমেটিক্স লাগবে আমি চুমকিকে নিয়ে যাচ্ছি।
রেবেকা বলল ঠিক আছে যাও। তবে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরবে।
মিথিলা বলল ঠিক আছে আম্মু। আমি তাড়াতাড়ি ফিরব। মিথিলা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াতেই কিছুক্ষণের মধ্যে মাসুম চলে এল।
মিথিলা মাসুমের বাইকে চড়তেই চুমকি বলে উঠল, আপামণি কোথায় যাচ্ছেন?
মিথিলা বলল তুই বাসায় চলে যা, আম্মুকে বলবি আমি আর আসব না, আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয়। খালু যদি আমাকে মারে।
তুই যা মারবে না, আব্বু যতই রাগ করুক না কেন? কখনো কাউকে মারে না।
কাজি অফিসে বিয়ে করে মাসুমের বাসায় উঠল দুজন। মাসুমের বাবা মা অন্যে ধরনের মানুষ, তাদের অনেক আশা ছিল, ছেলের বিয়েতে বড় অংঙ্কের যৌতুক নেবার।
কিন্তু ছেলের আচমকা এই ভাবে বিয়েটা মেনে নিতে পারচ্ছেন না তারা।
তাই নতুন বউকে বরণ করে না নিয়ে দুজনকেই অনেক কথা শুনালো।
মিথিলা বিষয়টা বুঝতে পেরে মনে মনে ভাবছে আব্বু কখনোই আমাদের বিয়েটা মেনে নেবে না।
শুধু হাতে এক কাপড়ে বাসা থেকে এসেছি বলে সবাই এরকম করতেই পারে, পরে হয়তো ঠিক একদিন মেনে নেবে।
মাসুম জানে সে পরিবারের প্রতি যে অন্যেয় করেছে, কেউ নতুন বউকে বরণ করবে না। তাই বাধ্য হয়ে নিজেই মিথিলাকে নিজের রুমে নিয়ে গেল।
রাত সারে এগারোটা বাজে দুজনে পাশাপাশি বসে, কারো মুখে কোনো কথা নেই।
যেন বিশাল একটা নীরাবতা।
মিথিলার মনটা খারাপ দেখে মাসুম বলে উঠল, তুমি ওদের কথায় কিছু মনে কর না।
দেখ মিথিলা ওরা আমাকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছে।
ওরা আমার বাবা মা আমি ওদেরকে খুব ভালোবাসি আর মায়ের পায়ে সন্তানের বেহেস্ত।
তুমি বাবা মাকে কখনো কষ্ট দিও না,
মায়ের একটু রাগ বেশি নিজেকে মানিয়ে নিও।
মিথিলা বলল দেব না।
তোমার বাবা মা তো আজ থেকে আমার বাবা মা। জীবনে যত ঝড় আসুক না কেন ? শুধু তুমি পাশে থেকো, তোমার কাছে আর কিছু চাইবো না।
মাসুম বলল আছি থাকব। সারা জীবন তোমার সুখে দুঃখে পাশে থাকব কথা দিলাম। এবার একটু হাস আমার সোনা বউ।
মিথিলা বলল আমার আব্বু আম্মুর কথা মনে পরছে, আমি আজ অনেক কষ্ট দিয়েছি তাদের। আমার বেহেস আমি হারিয়ে এসেছি, আজ আমি অনেক বড় পাপ করেছি।
এ কথা বলে মিথিলা কান্নায় ভেঙে পরল।
মাসুম মিথিলাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য তার বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল কেঁদ না জান, একদিন ঠিক দেখো মেনে নেবে। সন্তানের প্রতি পিতা মাতার রাগ সারা জীবন থাকে না পাগলি। যেদিন নাতি নাতনীর মুখ দেখবে সেদিন সত্যি সত্যি মেনে নেবে।
তুমি কেঁদ না তুমি কাঁদলে আমার খুব খারাপ লাগে। আমারো কান্না পায়, তুমি আমার কলিজা টুকরা, তুমি আমার প্রাণ, কেঁদ না Please সোনা পাখি।
আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসবো, ভুলেও কখনো কষ্ট দেব না, তুমি শুধু আমার।
এভাবে সুখে দুঃখে কেটে গেল একটি বছর, যে মেয়ে বাবার বাড়িতে এক কাপ চা নিজের হাতে কখনোই করে খেত না, সে মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে সমস্ত কাজ নিজের হাতে করে তবুও শ্বশুর শাশুড়ীর মন পায় না।
মিথিলার শ্বশুর শাশুড়ীর যৌতুকের লোভটা তখনো যায়নি যৌতুক না পাওয়ার কারণে মাঝে মাঝে মিথিলার উপর অমানবিক অত্যাচার করে। কিন্তু মিথিলা নিরুপায়, তাই তার শ্বশুর শাশুড়ীর এ অত্যাচার নীরবে মেনে নেয়।
মাসুমকে এ ব্যাপারে কিছুই বলে না। মিথিলার ভালোবাসা যে আজ ভালো নেই। কেউ জানে না সে কথা। প্রতিটা দিন কাটছে এখন নীরবে নিভৃতে শব্দহীন বেদনায়।
মিথিলা মনে মনে ভাবে, একদিন তার শ্বশুর শাশুড়ী তাকে ঠিকই মেনে নেবে।
সেটা কবে তা সে জানে না।
আমার দেয়া কষ্টে হয়তো, তোমরা ভালো নেই আব্বু আম্মু। আব্বু আমিও তোমাদের ছেড়ে ভালো নেই, আব্বু তোমার কথায় সত্যি হয়েছে, আমি সুখি হতে পারিনি। তোমাদের আজ খুব মিস করছি আব্বু আম্মু।