ভিক্ষাবৃত্তি ও যৌনকর্ম করতে বাধ্য হচ্ছেন হিজড়ারা

সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে হিজড়াদের স্বীকৃতি দিলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে তাদের। হিজড়াদের আয়ের উৎস মূলত ভিক্ষাবৃত্তি ও যৌনকর্ম।

সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাব, শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ না থাকা, চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনীহা এমন নানা কারণে হিজড়ারা বাধ্য হচ্ছেন এই ধরনের কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে।

ভিক্ষাবৃত্তি করেন এমন একজন হিজড়া জয়া জানান, হিজড়া হওয়ার কারণে ভাল ফল নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করার পরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার জন্য সুযোগ দেয়া হয়নি তাঁকে।

তিনি বলছিলেন, ‘আমার বাবা আমাকে পাঁচ থেকে ছয়টা কলেজে নিয়ে যান। তবে কোনো কলেজ থেকেই অনার্সে ভর্তির ফর্ম দেয়া হয়নি আমাকে।’

উচ্চশিক্ষার সুযোগ না পেয়ে তিনি পরবর্তীকালে একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। পরিচয় গোপন রাখতে সেখানে তাকে পুরুষদের পোশাক পরতে ও পুরুষদের মত আচরণ করতে বলা হয়। পরে সহকর্মীরা জানতে পারলে নানাভাবে যৌন হয়রানির চেষ্টা চালায় বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করলে তারা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে জয়াকে চাকরি ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। সেই পোশাক কারখানার কাজ ছেড়ে পরে জয়া ঢাকায় একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন। গৃহকর্ত্রী তাঁর প্রতি সদয় থাকলেও পারিপার্শ্বিক চাপে ছয়মাসের মধ্যে সেই কাজও ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। তারপর থেকে বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন জয়া।

একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেন আরেকজন হিজড়া। নাম তার রাণী। তিনিও জানান, সহপাঠীদের কাছ থেকে বিভিন্নসময় নানারকম তিরস্কার সহ্য করতে হয় তাকে।

রাণী বলেন, হিজড়াদের সহায়তায় বর্তমানে অনেক ধরনের কাজ হলেও তার সুফল পাচ্ছেন আর্থ-সামাজিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারের হিজড়ারা। দরিদ্র ও প্রান্তিক হিজড়াদের অধিকাংশই সে সব সুবিধাবঞ্চিত।

হিজড়াদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণ কি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক শাহ আহসান হাবীব বলেন, সংসদে স্বীকৃতি দেয়া হলেও তার ফলে হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়ন না হওয়ার কারণ বিভিন্নরকম আইনগত ও সামাজিক বাধা।

বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে হিজড়াদের অগ্রগণ্য কোনো জনশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তাই তাদের সমস্যা সমাধানেও সঠিক ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।, বলেন আহসান হাবীব।

‘বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে হিজড়াদের বিষয়ে এক ধরনের ভয় রয়েছে, যা অনেকটাই অপ্রকাশিত। আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত হলেও তৃতীয় লিঙ্গকে সাধারণ মানুষ মন থেকে কতটা মেনে নিয়েছে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।’ দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ হিজড়াদের শান্তিপূর্ণ একটি জনগোষ্ঠী মনে করে না।

অধ্যাপক হাবীব বলেন, মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলার সংস্কৃতিতে হিজড়ারা অভ্যস্ত হয়েছে। এই চাঁদাবাজির বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে এক ধরনের ব্যবসাও তৈরি হয়েছে বলে তিনি জানান।

অনেক সময় টাকা আদায়ের জন্য বলপ্রয়োগ ও দুর্ব্যবহার করে থাকে হিজড়ারা। যেটি সাধারণ মানুষের কাছে হিজড়াদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন।

হিজড়াদের এই ভিক্ষাবৃত্তিকে বাণিজ্য হিসেবে না দেখে তাদের নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে উলেখ করেন শাহ আহসান হাবীব।

তবে বর্তমানে ভিক্ষাবৃত্তির ক্ষেত্রে হিজড়ারা সাধারণত বলপ্রয়োগ বা দুর্ব্যবহার করার পক্ষপাতী না বলে জানান রাণী। সাধারণ মানুষের মধ্যেও হিজড়াদের সম্পর্কে ঘৃণা বা নেতিবাচক মনোভাব আগের চেয়ে কম বলে মনে করছেন তিনি।-বিবিসি