ভেস্তে যাচ্ছে কিম-ট্রাম্প বৈঠক?

উত্তর কোরিয়া বলছে, আমেরিকা যদি পারমাণবিক অস্ত্র নষ্ট করে ফেলার জন্য তাদের ওপর চাপ দেয় তাহলে তারা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে বসবে না।

ট্রাম্প ও উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত বৈঠকটি ১২ জুন সিঙ্গাপুরে হওয়ার কথা রয়েছে । এক বিবৃতিতে উত্তর কোরিয়ার উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী কিম গিয়ে-গুয়ান আমেরিকার বিরুদ্ধে অশুভ অভিপ্রায়ের এবং দায়িত্বহীন বিবৃতি দেয়ার অভিযোগ করেছেন।

তিনি এজন্য সরাসরি দায়ী করেছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনকে। আমরা খোলাখুলিই বলছি যে আমরা তাকে একজন জঘন্য মানুষ বলে মনে করি, বলেন কিম গিয়ে-গুয়ান।

কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার ব্যাপারে উত্তর কোরিয়া প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর কিম ও ট্রাম্পের মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের ঐতিহাসিক সম্মতি এসেছিল। উত্তর কোরিয়া বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোকে আমন্ত্রণও জানিয়েছিল এ মাসের পরের দিকে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার স্থান ভেঙে ফেলার ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য।

বোল্টন সম্প্রতি বলেছিলেন, উত্তর কোরিয়া লিবিয়া মডেল’ অনুসরণ করতে পারে যেখানে দেশটি যে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত হয়েছে তা যাচাইযোগ্য হবে, কিন্তু উত্তর কোরিয়া কর্তৃপক্ষ অতীতে এমন কথা বলেছে যে লিবিয়া ২০১১ সালে পশ্চিমা সামরিক অভিযানের জাঁতাকল হয়ত এড়িয়ে গেছে, কিন্তু তারা তাদের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।

সোলে বিবিসির সংবাদদাতা লরা বিকার বলছেন, উত্তর কোরিয়া বহুদিন থেকেই বলে আসছে রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকার জন্য তাদের পারমাণবিক অস্ত্র থাকা অত্যাবশ্যক। এখন দেশটি তাদের সেই দাবি আরও স্পষ্ট করছে।

বিবৃতিতে কী বলছে উত্তর কোরিয়া?

রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত কিমের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমেরিকা যদি আমাদের কোণঠাসা করে একতরফা দাবি করে যে আমাদের পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়তে হবে, তাহলে আমরা আলোচনায় আগ্রহী নই এবং ১২ জুন সিঙ্গাপুরে শীর্ষ বৈঠকে যোগদানের বিষয়টি আমাদের পুর্নবিবেচনা করতে হবে।

তিনি বলেছেন, উত্তর কোরিয়া খুবই আশাবাদী ছিল, কিন্তু এটা ‘খুবই দু:খজনক যে আমেরিকা শীর্ষ বৈঠকের আগেই উদ্ভট বিবৃতি দিয়ে আমাদের উস্কানোর চেষ্টা করছে।

কিম গিয়ে-গুয়ান উত্তর কোরিয়ার নেতাদের মধ্যে খুবই সম্মানজনক ব্যক্তি এবং আমেরিকার সঙ্গে আলোচনায় তিনি আগেও অংশ নিয়েছেন। তার বক্তব্য যে কিম জং-আন ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করবেন না এমন সম্ভাবনা খুবই কম।

এই বিবৃতি জারির কয়েক ঘন্টা আগে উত্তর কোরিয়া বুধবার দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে তাদের নির্ধারিত বৈঠকও বাতিল করে দিয়েছে। সেটাও সমস্যা যে আরও জটিল হচ্ছে তার একটা ইঙ্গিত।

উত্তর কোরিয়া হঠাৎ করে সুর বদলাল কেন?

সোলে বিবিসির সংবাদদাতা লরা বিকার বলছেন, উত্তর কোরিয়া বহু বছর ধরে এত বিশাল অর্থ ব্যয়ে যে পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে তার কারণ একটাই- নিজেদের সুরক্ষা দেয়া।

কাজেই জন বোল্টন রোববার এক বিবৃতিতে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করে ফেলার বিষয়টির সঙ্গে লিবিয়া বা ইরাকের যেভাবে তুলনা টেনেছেন, সেটা উত্তর কোরিয়ার জন্য মোটেই সুখকর হয়নি।

এটা ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি একটা হুমকিও বটে। ট্রাম্পের জন্য এই শীর্ষ বৈঠক কতটা জরুরি তা উত্তর কোরিয়া জানে। ট্রাম্প বিশাল চাপের কৌশল নেয়ার ফলেই যে এই শীর্ষ বৈঠকে উত্তর কোরিয়াকে রাজি করাতে আমেরিকা সফল হয়েছে এটা যে বলা হচ্ছে সেটাও তারা জানে।

আমেরিকা যেভাবে তাদের এই সাফল্যের বার্তা ছড়াচ্ছে, তাতে যে উত্তর কোরিয়া বিরক্ত সে ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। এখন তারা ক্ষমতায় গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের বক্তব্য পরিষ্কার তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জন বোল্টনকে কেন উত্তর কোরিয়ার অপছন্দ?

কট্টর রক্ষণশীল জন বোল্টন আমেরিকার ক্ষমতাকে সবচেয়ে বড় করে দেখেন এবং দেশের বাইরে সেই ক্ষমতা প্রকাশ করতে তিনি পছন্দ করেন, তা সংঘাতপূর্ণ হলেও। তিনি এর আগেও বলেছেন উত্তর কোরিয়ার ওপর প্রয়োজনে হামলা চালানো পুরোপুরি বৈধ।

সপ্তাহান্তে সংবাদমাধ্যমে তিনি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রসঙ্গে লিবিয়া মডেল অনুসরণের কথা বলেছেন। লিবিয়া ২০০০ সালের গোড়ার দিকে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়, যার ফলে তারা আবার অর্থনৈতিক সাহায্য পেতে শুরু করে এবং আমেরিকার সঙ্গে তাদের সম্পর্কও স্বাভাবিক হয়।

তবে ২০১১ সালে কর্নেল গাদ্দাফির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সময়, পশ্চিমা শক্তিগুলো লিবিয়া আক্রমণ করে, বিদ্রোহী বাহিনী গাদ্দাফিকে আটক করে ও হত্যা করে।

লিবিয়ার সঙ্গে তাদের তুলনা উত্তর কোরিয়া মোটেই পছন্দ করেনি। কিম গিয়ে-গুয়ান তার বিবৃতিতে বলেছেন, এধরনের বক্তব্য সংলাপের মাধ্যমে একটা সমস্যা সমাধানের পথে এগুনোর মনোভাব হতে পারে না।

‘পরাশক্তির হাতে লিবিয়া ও ইরাকের যে পরিণতি হয়েছিল তা আমাদের মত সম্মানিত একটা রাষ্ট্রের ওপরও চাপিয়ে দেয়ার এটা একটা চরম অশুভ অভিপ্রায়। তাকে (বোল্টন) যে আমরা যে খুবই অপছন্দের চোখে দেখি, সেটা আমরা লুকাতে চাই না।’

কিম আরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে ট্রাম্প যদি তার পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চান- অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ না করা পর্যন্ত আমেরিকা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কথা বলবে না – তাহলে ট্রাম্প তার পূর্বসুরীদের চেয়েও ব্যর্থ প্রেসিডেন্ট হিসাবে গণ্য হবেন। তিনি নজিরবিহীন সাফল্য অর্জনের যে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছেন তার থেকে অনেক দূরে সরে যাবেন।

উত্তর কোরিয়া যে একটা শক্ত অবস্থানে থেকে আলোচনার টেবিলে আসতে চাইছে তা তারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিতে চায়। তারা হয়ত এটাও ভাবছে যে সব ছাড় শুধু তারাই দিচ্ছে।

তারা সবরকম পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে, আটক তিনজন আমেরিকানকে মুক্তি দিয়েছে। কিম জং-উন দক্ষিণ কোরীয় প্রেসিডেন্ট মুনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং দুজনে একটা ঘোষণাপত্রে সই করেছেন। তারা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতিতে তাদের পারমাণবিক পরীক্ষাস্থল ভেঙে ফেলতে যাচ্ছে।

এত কিছুর পর যখন ট্রাম্প প্রশাসন এমন একটা চুক্তির জন্য কৃতিত্ব দাবি করছে যে চুক্তি তাদের পছন্দ নয়, সেটা উত্তর কোরিয়া মনে করছে বিষয়টাকে একটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।

কাজেই উত্তর কোরিয়ার দিক থেকে এধরনের বক্তব্য বিবৃতি এখন এমন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চুক্তির শর্ত যদি তাদের পছন্দ না হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের শীর্ষ বৈঠক থেকে তারা সরে আসতে প্রস্তুত। বিবিসি বাংলা।