মধু ভোর || নাজমীন মর্তুজা

পাক্কা আঠারো ঘন্টা জার্নির পর এই শহরে নামলাম।
এটা আমার গন্তব্য নয় কিন্তু মাঝ পথে স্পেন্ডরের ট্রেনটা কেমন বেঁকে বসলো….
পায়ের আংটি নুপুর সব কেমন আঁটসাঁট হয়ে বসে আছে…
সত্যি জানি না এটা কোন শহর….
কাঁধ বাঁকিয়ে রাস্তার দোকানের নেম প্লেটে দেখলাম হাঁওডা….
বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা ধুকপুকের দ্রুত লয় টের পাচ্ছি। একটা দুটো পাখি নোংরা ঘাটছে, দুটো কুকুর লীলা রতির পর কেমন শেষ আমেজের সুখ নিতে চক্রাকারে একে অন্যের পেছনে ঘুরছে।
একটা বুড়ো বিমর্ষ হয়ে নিচু মুখো হয়ে ঝাড়ু দিচ্ছে। তার মনোযোগ দেখে মনে হচ্ছে জগত সংসারের তাবৎ ময়লা ঝাড়ু দিয়ে ফকফকা করাই যেন তাঁর কাজ। ভাবছি কোন দিকটায় যাবো … ডানে- না বাঁয়ে..!
একটু সামনে এগুতেই দেখি একটা চলটা ওঠা দেয়াল, ক্ষয়ে যাওয়া ইটগুলো দাঁত কেলিয়ে হাসছে। মাঝখানটায় না হ, ঠিক মাঝ খানটায় না একটু চেপে, .. কারা যেন সুবোধের মতো কাকে এঁকেছেন, হাত পাকা না, তাই বোঝা যাচ্ছে না পরিস্কার করে আসলে কি এঁকেছেন। লোকটা উল্লাসে মেতেছে না শোকে আহাজারী করছে ঠিক বোঝা গেল না।
দিদিমনি পেপার লাগবে..?
ঝটপট কিছু বুঝতে না বুঝতেই হাতে গুঁজে দিয়ে বল্লো পয়সা দিন, ও দিকটায় যাবো। সক্কাল সক্কাল দু’চারটে না বেচলে বেলা হয়ে গেলে অন্য মাল হাতে চলে আসবে।
দিন দিন পয়সাটা আমি অবাক হয়ে ওয়ালেট হাস্তে দেখি… আমার কাছে পয়সা নেই।
পেপারটা নাও পয়সা নেই রে ভাই।
আর আমি এদেশের খবর পড়ে কি করবো বলো!
ছেলেটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চলে গেল।
আমিও সামনে চলে যাচ্ছি… রিক্সায় ভেঁপু বাজছে অনবরত মনে হচ্ছে যেন উৎসব এদেশের আনাচে কানাচে…
দূরে একটা রিক্সাওয়ালা হাঁকছে, এই যে দিদিমনি —এই দিকে… কোথায় যাবেন চলুন নামিয়ে দিয়ে আসি।
তার ডাকে আমিও গিয়ে হাজির…
কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো আমি তো কাওকেউ চিনি না এ শহরে
তবু বল্লাম আচ্ছা চলো… চেপে বসতেই জিজ্ঞেস করলো ডানে না বায়ে…
আমি মানুষ দেখছি, ভাতের ফেনের মতো সকাল.. চারদিকে একটা গতিময়তা
একটা আয়োজন চলছে দিনের শরীরে মাখন লাগিয়ে দিনটিকে প্রস্তুত করতে।
এই যে দিদিমনি শুনতে পাচ্ছেন না… বলছি কোন দিকে ছুটবো?
আসলে আমি জানি না কোথায় যাবো?
আচ্ছা ভাই….
তুমি কি একজন লেখককে চেনো…?
তার একটা বইয়ের নাম জানি…
উমমম … “বাউড়ি বাতাস” ভীষণ ভালো কবিতা লেখে চেনো….
নাহ গো দিদিমনি আমি চিনি না।
তোমাকে বইয়ের দোকানে নিয়ে যাই
ওরা বলতে পারবে ঠিক
আমিও ভাবছি বেশ তবে চলো …
আমার কাছে অচেনা শহরের ধুলো
শব্দ গন্ধ হঠাৎ চেনা মনে হতে লাগলো
একটা খোঁজ আমাকে আপন ভাবাচ্ছে
আমাকে আপ্লুত করছে ….
আমি আসলে কেন খুঁজছি লোকটাকে কি দরকার?
হাজারটা প্রশ্ন… পায়ের আঙ্গুলগুলো ফুলে ঢোল, ভেতরে কেমন কুট কুট করছে… স্বস্তি পাচ্ছি না।
একটা বস্তির মহিলা ভাত সমেত কালো একটা হাঁড়ি রাস্তায় ছুঁড়ে দিয়ে
দ্রুত আমার রিক্সায় সামনে আসছে।
বলি ও মরদ তোর ভাত দেবার মুরোদ নেই আর গতর চষে বেড়াস ..
কাউকেও ছাড়লিনে।
আমার ফুলের মতো বোনটাকেও নরকের রাস্তা দেখিয়ে ছাড়লি তুই… কি দুনিয়া এলো ভগবান সব দেখি লিঙ্গের আগায়।
তোর সংসারের মুখে আগুন… আজ তোর মুখে আগুন দেবো বলছি… আজ যদি একটা বিহিত না করতে পারি তবে আমার নাম মিনতি না হুমমম বলে গেলাম!
আমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি,
আহা কি হয়েছে যে মহিলা নিজের স্তনের উপরের কাপড়টা পর্যন্ত ঠিকঠাক ঢাকেনি!
ঈশারা করে বল্লাম এই যে আপা
আচঁলটা টেনে নেন …
আপনি মনে হয় খেয়াল করেন নি।
ঝাঁঝিয়ে উঠে বল্লো এই যে বড় নোকের বিটিরা কি বুঝবেন আমার মতো মানুষের মনে কত কষ্ট… সোয়ামীর জ্বালা.. পেটের জ্বালা… গতরের জ্বালা…
একটু সংযত হয়ে বলছি প্লিজ একটু শান্ত হউন….
রিক্সা চলছে স্লোথ।
এই যে দিদিমনি ওদের সাথে কথা বলতে যাবেন না খারাপ মেয়ে মানুষ।
আমার তো তা মনে হলো না …. ঠিক আছে আপনি চালান।
আচ্ছা আপনি কি নতুন এয়েছেন
একটু নড়েচড়ে বসলাম … নাহ ঠিক তা না … আমি কল্পনায় বহুবার এসেছি এবার বাস্তবে।
লোকটা পেছন ফেরে আমাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিলো
এই যে এসে পড়েছি… সামলের মোড়টার একটু ডানে গিয়েই বই দোকান
যে কাউকে বলবেন বলে দেবে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আমার কাছে পয়সা নেই মানি একচেঞ্জ করতে হবে …
দশটাকা বেশী রাখো…
সুন্দর একটা বুদ্ধি দেবার জন্য …।
আসি গো দিদিমনি । হুম এসো ।
তাঁর কেলানো হাসির ঝিলিকটা বড্ড মনোহর।
আচ্ছা আমি একজনকে খুঁজছি
আসলে উনার একটা বই পড়েছি
টিভি ইন্টারভিউ দেখেছি … উনার নাম চিন্ময়….
চেনেন?
কোন প্রকাশনি বলতে পারবেন?
না ঠিক মনে নেই …. দেখুন তো উনি কি না ?
বইয়ের ফ্লোপের পাশে তার ঝকঝকে ছবি
রুপোর মতো দাঁত গুলো ঝিলিক দিচ্ছে
সাউথের লোক নাকি উনি?
নাহ নাহ … উনি ওপার বাংলার বাপের আমলে চলে এসেছে। বড্ড ভালো কাজ করছেন আজকাল।
তাই নাকি ?
তা কত গুলো বই আছে উনার
৭/৮ টা তো হবেই ।
বেশ ।
এখন লিখছে কম মিছিল মিটিং এ বেশী দেখি …
এই যে এটাতে বৈতরণী পুরস্কার পেলো
পড়ুন ।
আসলে একটা কথা বলতে চাচ্ছি
মানে আমি না উনার দেখা কোথায় পাবো বলতে পারেন ?
তা জানি না ঐ যে মেডিকেলের ছাত্ররা অনশন করছে ওখানে আসে রোজ
গণসঙ্গীত চলে বক্তৃতা চলে
দেখুন পেয়ে যেতে পারেন ।
সবে তো সকাল … আমার রাতে ট্রেন ….
এখানে কোথায় আমি বসে সময় কাটাতে পারি?
হোটেল না প্রকৃতির কাছে।
আছে তো কত ভালো ভালো প্লেস
এক কাজ করুন ভিক্টোরিয়ায় গিয়ে বসে পড়ুন।
ধন্যবাদ …. ।
টেক্সি মিলছে না হাঁটছি … অচেনা শহর ভাষাটা এক … বলার ভঙ্গিটা ভিন্ন … । রাস্তাটা চেনা মনে হচ্ছে,
হয়ত এই পথেই হেঁটে গেছে বহুবার সে
ভাঁড়ের চায়ে ঠোঁট বসাতেই পাটল মাটির গন্ধ পেলাম
এটা কি তার শ্বাসের ঘ্রাণ …?
চারদিক শুধু চিন্ময় …আমি পুরে যাচ্ছি অচেনা শহরে … ক্লান্ত হতে হতে আবেশে মন হারাচ্ছে তার কথা ভেবে।
তার বলবার ভঙ্গি সবার সাথে মিলে যাচ্ছে চা ওয়ালা পেপার ওয়ালা টাঙ্গাওয়ালা … বই দেকানী .. ট্যাক্সিড্রাইভার .. রাস্তার মহিলা … সব্বাই যেন তার মতো করে কথা বলছে ।
পরি- মরি করে ছুটলাম তখন সন্ধ্যে সাতটা,
অনশন স্পটে … মেডিকেল স্টুডেন্টরা প্রায় মরু …মরু … স্যালাইন দেয়া … কেউ বা মার্কিন কাপড়ে নুনজল মিশিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে …. সবার চোখ স্থবির … শত শত লোক জটলা পাকিয়ে ভিড় ঠেলে সামনে এগুতেই চিনলাম এক মহিলাকে কোথায় যেন দেখেছি … হুম মনে পড়ছে টিভিতে … আমি শুনেছি সেদিন তুমি
এমন একটা গান গেয়েছিল । একটা লোক তদারকী করছে সব কেমন এলোমেলো …
এই যে ভাই একটা ইনফরমেশন দেবেন প্লিজ ….।
জ্বি বলুন কি …
আমি আসলে বাংলাদেশ থেকে এসেছি, হুম তো কি চাই? সাংবাদিক টাংবাদিক নাকি?
আচ্ছা আজ কি চিন্ময় দা আসবেন?
এসেছিল তো … দুঘন্টা হলো … ঐ যে ঐ দিকটায় চলে যান পেয়ে যাবেন।
দ্রুত ভিড় ঠেলে যাচ্ছি …..
সিগারেট … গাঁজার মিশেল গন্ধ …
যাচ্ছি …..যাচ্ছি,
দেখলাম কত পরিচিত শিল্পী কত লেখক
আরি ব্বাহ ….
আমি এদের সব্বাইকে চিনি।
লজ্জার আড়মোড়া ভেঙ্গে একটু এগিয়ে গিয়ে বল্লাম
এক্সকিউজমি … আচ্ছা চিন্ময় দা কে খুঁজছিলাম …
ও চিন্ময় দা এক্ষুনি তো ছিল … !
কোথায় গেল হঠাৎ … এই তো ব্যাগ পড়ে আছে … । সবাই কেমন তন্ন তন্ন করে খুঁজছে এদিক ওদিক …
একজন উপোযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করতে এলো আপনি … মানে … আসলে … চিন্ময় দার কি হোন..?
আমি কিছু হই না উনার ভক্ত “বাউড়ি বাতাস” পড়ার পর আমি উনার প্রেমে পড়ছি ।
লোকটা হাসলো.. ভালো বলেছেন লেখকের প্রেমে … সবাই পড়ে .. তাই না …?
একটা লোক এসে বল্লো চিন্ময় দা একটু বেড়িয়েছে গো .. ব্যাগ নেয়ার সময় পায়নি … তুলে রাখি….।
কখন ফিরবে কিছু জানেন?
নাহ… বাউন্ডুলে পাবলিক কোথায় কি কাজ পড়েছে চলে গেছে…।
আচ্ছা … একটু আমতা আমতা করে বল্লাম চিন্ময়দার ব্যাগটা দেবেন
না মানে ছুঁয়ে দেখতাম… কিছুক্ষণ পর আমার ট্রেন…. ছেলেটা মৃদু হাসছে…
হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিয়ে চেয়ারে বসলাম… লোকটা একটু দূরে চলে গেল।
আমি ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিবিড় আলিঙ্গন করছি
এলোপাতাড়ি চুমো দিচ্ছি
দেখলাম আশেপাশে কেউ নেই…
আমি সাবলিল ভাবে হাতে চিন্ময়দার ব্যাগ নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম ….।
কেউ কিছু বল্লো না পিছু ডাকলো না…
টেক্সিকে বল্লাম
ভাইয়া জ্বি হাওড়া চালিয়ে…
ওকে দিদি,
আমি যেন সমস্ত দুনিয়ায় সুখ সঙ্গে করে নিয়ে ছুটছি… ভীষণ রিচ মনে হচ্ছে …
স্পেন্ডরের ট্রেন হুইসেল দিয়ে ছুটলো… আমি থলে ব্যাগ হাতরে পেলাম লাইটার …ডায়েরী ছোট নোট বুক
একটা বই কবিতার …আর এক প্যাকেট সিগারেট
প্রথমে সিগারেটে আগুন দিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরলাম ….। জীবনে প্রথম সিগারেট ফুঁকছি ।
তারপর ডায়েরী খুলে দুটো লাইন দেখে স্ট্যাচু হয়ে গেলাম …….
“একদিন মধুভোরে নম্রতা আসবে
আমার আলিঙ্গন চাইতে
আমি তার আয়োজনে দিন মাস বছর
পার করছি ……
সে আসবে একদিন মধু ভোরে….।”