মাগো, অভিযানের লাগাম টানো, প্রধানমন্ত্রীকে আ.লীগ নেতা

মাদকবিরোধী অভিযানে গুলিতে কক্সবাজারের টেকনাফে সরকারদলীয় নেতা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিহতের পর এই অভিযান থামাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আকুতি জানিয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন কক্সবাজারের পৌর মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী।

জনাব চৌধুরী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও। দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে এই চিঠিটি তিনি পোস্ট করেছেন ফেসবুকে, আশা করছেন, তার নেত্রীর কাছে এই আহ্বান পৌঁছে যাবে।

গত ৪ মে থেকে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে। র‌্যাব ও পুলিশের এই অভিযানে শুরুর দিকে খুব একটা প্রাণহানির খবর না পাওয়া গেলেন গত আট দিন ধরেই প্রতিদিন গড়ে ১০ টি করে মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই কথিত বন্দুকযুদ্ধে এবং কয়েকজনের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার হয়েছে, কিন্তু বন্দুকযুদ্ধ বলে স্বীকার করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এর মধ্যে গত রাতে কক্সবাজারের টেকনাফে গুলিতে নিহত হন টেনকাফের তিন নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, টেকনাফ যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুল হক।

আর এই মৃত্যুতেই ব্যথিত কক্সবাজারের পৌর মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী।

নিহত একরামকে নির্দোষ দাবি করে তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার বলেও দাবি করা হয় চিঠিতে। স্থানীয় আরও কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়েও সংশয়ের কথা বলেন মাহবুবুর রহমান চৌধুরী।

প্রধানমন্ত্রীকে ‘মা’ সম্বোধন করে তার মাধ্যমে প্রশাসনকে আওয়ামী লীগ নেতা লেখেন, ‘যদি সমাজ থেকে মাদক নির্মূল করতে চান, তবে প্রকৃত ইয়াবাকারবারীদের শেষ করুন।’

‘পারলে টেকনাফের সাইফুল করিম, এমপি বদির ভাই আবদুর রহমান ও আবদুর শুক্কুর, কক্সবাজার শহরের শাহাজাহান আনসারী ও কামাল আনসারী, লারপাড়ার আবুল কালাম কন্ট্রাকটার, পেকুয়ার মগনামার ওয়াসিমের মত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তালিকাভুক্ত ও সমাজ স্বীকৃত ইয়াবাকারবারীদের ক্রসফায়ার দিন।’

‘দয়া করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে কলঙ্কিত করবেন না। একরামের মতো নিরাপরাধ ও জনপ্রিয় নেতাকে ক্রসফায়ার দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার তথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গায়ে কালিমা লেপনের চেষ্টা করবেন না।’

একরামের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ ইয়াবা মুক্ত হয় তবে কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে বলেও মন্তব্য করেন কক্সবাজারের পৌর মেয়র।

এই অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা গুলিতে এখন পর্যন্ত ৯০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার কর্মী, বিএনপি ও সমমনারা এই অভিযান নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়ে আসছেন। তারা কথিত বন্দুকযুদ্ধের বর্ণনা না মেনে একে বিচারবহির্ভূত হত্যা আখ্যা দিচ্ছেন। গুলি করে হত্যার বদলে বিচারের দাবিও তুলছেন তারা।

তবে আওয়ামী লীগ এই অভিযানের পক্ষ নিয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, দেশকে মাদকমুক্ত করতে এর বিকল্প নেই। এই প্রথম এই দলের জেলা পর্যায়ের একজন নেতার পক্ষ থেকে এ নিয়ে আপত্তি উঠল।

‘একরাম নির্দোষ, চক্রান্তের শিকার’

একরামকে আজন্ম আওয়ামী লীগ পরিবারের অহংকার আখ্যা দিয়ে মাহবুব লেখেন, প্রশাসনকে ভুল বুঝিয়ে এই কাজটি করা হয়েছে।

শেখ হাসিনাকে ‘মা’ উল্লেখ করে কক্সবাজারের মেয়র বলেন, ‘মাগো এমন চলতে থাকলে আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশ নিঃশেষ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।’

‘আপনি তো আপনার সন্তানদের চিনেন। আপনি তো আমাদের সকল খবর রাখেন। আপনি বলেন, আপনার যেই সন্তান আজন্ম বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ছড়িতে দিতে কাজ করেছে। আপনার যে সন্তান দুঃসময়ের মধ্যেও টেকনাফ যুবলীগকে মডেল ইউনিটে পরিণত করেছিল। আপনার সেই সন্তান একরামুল হক কি ইয়াবার মত মরণ নেশার সাথে জড়িত থাকতে পারে?’

‘যার চাল চুলো নেই, থাকার জন্য বাড়ি নেই। পরিবার ও সন্তানদের লেখাপড়া চালানোর জন্য যাকে নির্ভর করতে হয় ভাইদের উপর, বন্ধুদের উপর। আওয়ামী লীগকে ভালবেসে জনগণকে সেবা করতে গিয়ে দেনার দায়ে যার সব শেষ তাকে বানানো হচ্ছে ইয়াবা গড়ফাদার! হায় সেলুকাস।’

‘মাগো, আমি আমার কান্না রুখতে পারছি না। একরামের মৃত্যুতে আমার হৃদয়ে ক্ষণে ক্ষণে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এ হত্যা মানতে পারছি না।’

নিহত একরামের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে মাহবুবুর রহমান লিখেন, ‘আমি যখন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, তখন একরাম টেকনাফ যুবলীগের সভাপতি। তাই সাংগঠনিক কারণেই আমি তাকে কাছ থেকে চিনি।’

‘একরামের কথা ভাবলেই চোখের সামনে চলে আসে তার দুই মেয়ের ছবি। কী হবে এখন তাদের? কী ছিল তাদের বাবার অপরাধ? তবে কি বর্তমান প্রতিহিংসার রাজনীতি কেড়ে নিল আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কা-ারিকে।’

একরামকে ‘দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের একজন খাঁটি নির্লোভ যোদ্ধা’ উল্লেখ করে কক্সবাজারের আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘হয়ত বা এই কারণেই মাদক বিরোধী অভিযান প্রশ্ন বিদ্ধ করতে শকুনের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি একরাম।’

‘একরামের মৃত্যু আওয়ামী লীগের ত্যাগী বিশ্বস্তদের জন্য অশনি সংকেত’ উল্লেখ করে খোলা চিঠিতে প্রশ্ন করা হয়, ‘একরামকে হত্যার মধ্য দিয়ে তবে কি টেকনাফকে আওয়ামী লীগ শূন্য করার কাজ শুরু হয়ে গেল?’

‘বড় ভয় হচ্ছে সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা নুর হোসেন এবং টেকনাফ যুবলীগের সভাপতি নুরুল আলমের কথা ভেবে। তাদের দিকেও তো একটি মহলের কুদৃষ্টি রয়েছে।’

শেখ হাসিনাকে কক্সবাজারের মেয়র লেখেন, ‘মা, এখনও সময়, লাগাম টেনে ধরো তাদের। যারা প্রকৃত মুজিব আর্দশের সৈনিকদের হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে।’

২০০৮ সালে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে একরামের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল উল্লেখ করে খোলা টিছিতে বলা হয়, ‘তখন তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলাও হয়েছিল। যদিও মামলাটিতে একরাম নির্দোষ প্রমাণিত হয়। সেই সূত্রে ২০১০ সালে নাম ওঠে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রথম তালিকাতেও। কিন্তু ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার বদলির পর সেটা সংশোধন হওয়ায় নিরাপরাধ এ জনপ্রিয় কমিশনারের নাম বাদ পড়ে যায়।