মিয়ানমারের ছয় সেনাসদস্যের ১০ বছরের বিরল কারাদণ্ড

মিয়ানমারের যুদ্ধবিধ্বস্ত কাচিন প্রদেশে তিন বেসামরিককে হত্যার দায়ে ছয় সেনাসদস্যের ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির সেনাবাহিনীর একটি আদালত। দেশটির কর্মকর্তারা শনিবার ওই ১০ সেনাসদস্যের দণ্ডের তথ্য জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সেনাবাহিনীর বিরল এ সাজার রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।

কাচিন রাজ্য পুলিশের কার্যালয় বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিগত কাচিন সম্প্রদায়ের তিন বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে ছয় সেনাসদস্য। শুক্রবার সেনাবাহিনীর একটি আদালত ওই সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ তদন্তের পর এ রায় ঘোষণা করা হয়।

কাচিন রাজ্য পুলিশের কর্মকর্তা মিন জ্য বলেছেন, শুনানির সময় অভিযুক্ত ছয় সেনাসদস্য ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে। দেশটির কাচিন প্রদেশের স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের সংগঠন কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চলছে। লড়াইয়ে এক লাখের বেশি কাচিন তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এদের অধিকাংশই শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে।

তবে শনিবার বার্তাসংস্থা এপি ছয় সেনাসদ্যেসর দণ্ডের ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কোনো মন্তব্য পায়নি। গত বছরের মে মাসে শরণার্থী শিবিরে ফেরার পথে পাঁচজনের একটি দলকে আটক করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। কা প্রা ইয়াং গ্রামের পাশে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের পর তারা শিবিরে ফিরছিলেন। এদের মধ্যে দু’জনকে ছেড়ে দেয়া হলেও বাকি তিনজনের মরদেহ তিনদিন পর একটি গর্তে মেলে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ছয় সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে তা মিয়ানমারে বিরল। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের যে অভিযোগ আছে সেসবের দায়মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ এটি। তবে রুদ্ধদ্বার আদালতে এ বিচার অনুষ্ঠিত হওয়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে তারা।

গত নভেম্বরের শুরুর দিকে কাচিনের পার্শ্ববর্তী শিন রাজ্যে ব্যাপক প্রাণঘাতী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পালেতওয়া এলাকায় আরাকান আর্মির সদস্যদের সঙ্গে ওই সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অন্তত ১১ সদস্য নিহত ও আরো ১৪ জন আহত হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাচিন, রাখাইন ও শিন প্রদেশের বিদ্রোহীদের পাশাপাশি আরাকান আর্মির সদস্যরাও ক্রমান্বয়ে সক্রিয় হয়ে উঠছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বারবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে তারা।

২০১৬ সালে দেশটির বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকারের শান্তি-প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়। সেই সময় শান্তির প্রক্রিয়ার একটি রেফারেন্স গাইডে বলা হয়, আরাকান আর্মি গঠিত হয়েছে ২০০৮ সালে। জাতিগত রাখাইন জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গঠনই এ সংগঠনটির মূল লক্ষ্য।

অপর বিদ্রোহী গোষ্ঠী কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মির (কেআইএ) মিত্র গোষ্ঠী হচ্ছে আরাকান আর্মি (এএ)। তাদের অর্ধেকের বেশি সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেয় কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মি। আরাকান আর্মির অস্থায়ী প্রধান কার্যালয়ও কেআইএ নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। রাখাইনের কিয়াকত্য, ম্রক-ইউ ও মিনবিয়াসহ শিনের পালেতওয়া এলাকায় সক্রিয় রয়েছে আরাকান আর্মি।

কেআইএ, এএ ও তা’আঙ ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও কোকাংভিত্তিক মিয়ানমার ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি মিলে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স নামে একটি জোট গঠন করেছে। ২০১৫ সালে দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সরকারের স্বাক্ষরিত দেশব্যাপী জাতীয় শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থেকেছে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স।

গত বছর সীমান্ত বাণিজ্য অঞ্চলে একাধিকবার হামলা ও মান্দালয়-ল্যাসিও-মিউস মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর তা সাময়িক বন্ধ করে রাখে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স। এ ঘটনার পর শান রাজ্য কর্তৃপক্ষ নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দশকের পর দশক ধরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে আসছে। সহিংসতাপ্রবণ বেশ কিছু অঞ্চলে সেনাবাহিনীর লড়াইয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও অভিযোগ রয়েছে।

গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার জেরে সেনাবাহিনী ক্লিয়ারেন্স অপারেশন শুরু করে। অভিযানে এখন পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবািহিনীর এ অভিযানকে জাতিগত নিধন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

গত সপ্তাহে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে ১০ রোহিঙ্গা হত্যার সঙ্গে সেনাসদস্যরা জড়িত বলে বিরল এক স্বীকারোক্তি দেয়। এ ১০ রোহিঙ্গার মরদেহ উত্তরাঞ্চলের রাখাইন ইন দিন গ্রামের গণকবরে পাওয়া যায়।