মেক্সিকোর কারাগারে বন্দি কয়েক হাজার বাংলাদেশি

অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় মেক্সিকোর ভূখণ্ড থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আটক হয়েছেন কয়েক হাজার বাংলাদেশি।

বর্তমানে তারা মেক্সিকোর বিভিন্ন কারাগারে আটক। কূটনৈতিক সূত্রগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। দেশটিতে বাংলাদেশি বন্দির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলেও জানা গেছে।

সম্প্রতি এ বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দেশটির জাতীয় অভিবাসন সংস্থার (আইএনএম) কর্মকর্তারা। তারা এ বিষয়ে সে দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে উদ্বেগ জানিয়েছেন।

বৈঠকে জানানো হয়, সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়া থেকে মেক্সিকোয় অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছেন। অভিবাসীদের মূল লক্ষ্য হলো সুযোগ বুঝে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা। অবৈধ এ মানবপাচারের সঙ্গে দূতাবাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ দেশটির।

উন্নত ও সচ্ছল জীবনের আশ্বাস দিয়ে স্বপ্নভূমি যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে গরিব ও খেটে খাওয়া গ্রামের মানুষগুলোর কাছ থেকে ২৫-৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মাইগ্রেশন, মেক্সিকো (আইএনএম) এবং ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন এজেন্সি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে যথাক্রমে ১৪৯, ১৬৭, ৩২৮, ৬৯০, ৬৪৮, ৬৯৭ ও ১২০ বাংলাদেশি আটক হন। তারা বর্তমানে মেক্সিকোর জেলে বন্দি।

অন্যদিকে ইউএস বর্ডার প্রটেকশন এজেন্সির হাতে গত ছয় বছরে আটক হয়েছেন দুই হাজার চারশর বেশি বাংলাদেশি।

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের আগে কয়েকটি দেশ হয়ে মেক্সিকোয় আসেন বাংলাদেশিরা। কখনও কখনও ১০-১২টি দেশ পার হওয়ার ঘটনা ঘটে।

মানবপাচারের রুট হিসেবে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে প্লেনে দুবাই/ইস্তাম্বুল/তেহরান এরপর ভেনিজুয়েলা/বলিভিয়া অথবা স্প্যানিশ গায়ানা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার রুট রয়েছে আরও কয়েকটি।

ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, গায়ানা ও বলিভিয়া থেকে দুর্গম পথে যাত্রা করে কলম্বিয়া-পানামা-কোস্টারিকা-নিকারাগুয়া-এল সালভাদর-গুয়াতেমালা হয়ে মেক্সিকো। এরপর মেক্সিকো থেকে সুযোগ বুঝে সীমানা অতিক্রম করে স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানো সম্ভব হয়।

পাচারকারীরা সাধারণত জনবহুল এলাকা এড়িয়ে মরুভূমি, পাহাড় কিংবা জঙ্গল পথে যেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি কম; সেসব রুট ব্যবহার করেন।

দুর্গম এসব পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আবার কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ছয় হাজারেরও বেশি মরদেহ উদ্ধার করেছেন। তবে এর মধ্যে কতজন বাংলাদেশি, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তারা।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো মানুষগুলো আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের কবলে পড়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, অনেক ক্ষেত্রে তারা মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন- এটিই সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়।

ভুক্তভোগীরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে যেতে আগ্রহীদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করা হয়। অর্থ আদায়ের কৌশল হিসেবে অপরাধীচক্র অবৈধ অভিবাসীদের দু-একজনকে হত্যা করে বাকিদের ভয় দেখান। মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে অনেকেই তাদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার সংস্থান করতে বাধ্য হন।

ভুক্তভোগী এমন এক পরিবারের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই পরিবারের কর্তা জানান, ছেলেকে আমেরিকা পাঠাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতে হয়েছে। ছেলেকে দালালদের হাত থেকে মুক্ত করতে প্রায় কোটি টাকা দিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

মেক্সিকোর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের হিসাব মতে, প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার অভিবাসী অপহরণের শিকার হন। পরবর্তীতে মুক্তিপণের দাবিতে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে মেক্সিকো আনতে যে চক্রটি কাজ করছে তাদের মূল হোতা হিসেবে আতিক হোসেইন, দুলাল হালদার ও দিদার হালদারের নাম জানা গেছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তাদের গ্রেফতার করে মেক্সিকান পুলিশ। পরবর্তীতে আতিকের বাড়ি থেকে পাঁচ বাংলাদেশি, দুই ভারতীয় ও ছয়জন নেপালের নাগরিককে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। পরে অভিযুক্তদের তিন বছরের জেল হয়।

আতিক হোসেন ও তার ভাই আহাদ হোসেনের ‘ক্যাসে ইলিফান্তে’ ও ‘তাজমহল’ নামে মেক্সিকোসিটিতে দুটি রেস্তোরাঁ রয়েছে।

সূত্র জানায়, মূলত রেস্তোরাঁ ব্যবসার আড়ালে মানবপাচারের অপকর্ম চালাত তারা। বেশিরভাগ অবৈধ বাংলাদেশির প্রাথমিক ঠিকানা হতো হোসেন ভাইদের রেস্তোরাঁ। দুলাল হালদার ও দিদার হালদার মানবপাচারের পাশাপাশি মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত বলে অভিযোগ আছে।

এছাড়া মানবপাচারের আরেক হোতা রতন; যাকে মেক্সিকান কর্তৃপক্ষ ও ইন্টারপোল খুঁজে বেড়াচ্ছে।

মানবপাচারের বিশাল সিন্ডিকেট মেক্সিকো ছাড়াও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে বিস্তৃত। নিকারাগুয়ার আবদুর রহমান সেলিম এ চক্রের মূল হোতা। বলিভিয়া থেকে এ অপরাধের নিয়ন্ত্রণ করেন শাহীন; যিনি ইন্টারপোল ও বলিভিয়া পুলিশের তালিকাভুক্ত অপরাধী।

দুলাল হালদার ও দিদার হালদারের ভাই কামাল হালদার আর্জেন্টিনা থেকে এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করেন। পাশাপাশি তিনি ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ের মানবপাচারকারী চক্রের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া বলিভিয়া থেকে জয়নাল আবেদিন, ইকুয়েডর থেকে কামরুল হাসান ও তৌহিদ ইবনে শামীম, ব্রাজিল থেকে ডন মানবপাচারের নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন।

অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বিভিন্ন সময়ে মেক্সিকোতে জেলখাটা বাংলাদেশি, মধ্য ও লাতিন আমেরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর অভিবাসন সংস্থা, ইন্টারপোলের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।

বেশিরভাগ বাংলাদেশি যারা মেক্সিকোসিটিতে বসবাস করেন, তারা মূলত আতিক হোসেইন-দিদার হালদার-দুলাল হালদারের হাত ধরেই এসেছেন। আতিকের বাড়ি টাঙ্গাইল এবং দিদার-দুলাল দুই ভাইয়ের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে।

অভিযোগ আছে, মানবপাচারকারী চক্রটির সঙ্গে মেক্সিকোসিটির বাংলাদেশ দূতাবাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। মেক্সিকোসিটি প্রশাসনের আয়োজনে বার্ষিক সংস্কৃতি মেলায় অংশ নিয়ে তারা দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেন। এর মাধ্যমে গরিব বাংলাদেশিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া অর্থ সাদা করে নেন মানবপাচারের হোতারা।

এদিকে অবৈধভাবে সীমানা অতিক্রমের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এখন জেল খাটছেন অনেক বাংলাদেশি। আবার অনেকেই আত্মসমর্পণ করে সেদেশে আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন অনেকে ‘অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন’- এমন অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুযোগ নিচ্ছেন।

তবে পরিসংখ্যান বলছে, মার্কিন অভিবাসন আদালত বাংলাদেশিদের প্রতি তেমন সদয় নয়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে মাত্র ১৩ শতাংশ বাংলাদেশির আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ৩৮ বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তাদেরও অপরাধ ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’।