মোটরসাইকেলে কেন এত দুর্ঘটনা?

গত ৭২ ঘণ্টায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবরে শুনেছি। গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত পুরানো ঢাকার বিভিন্ন রোডে ঘুরার কারণে ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া মোটরসাইকেল তরুণ চালকরা যে কী ভয়ঙ্কর ফ্যান্টাসিতে মেতে ওঠে তা কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে।

আর চিকিৎসক হিসেবে অর্থোপেডিকসে ডিউটি করে আমার মনে হচ্ছে যেকোনো যানবাহনেই এক্সিডেন্ট হতে পারে তা সত্যি–তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মোটরসাইকেল আরোহীরা এর প্রধান ভিক্টিম।

আসলে এ কয়েকদিনেই এমন বীভৎস কিছু কেস পেয়েছি যা নিজ চোখে না দেখলে কখনোই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আজ দুপুরে যে পেশেন্টটা এলেন–তার কোমর আর কোমরের সঙ্গে লাগানো দেহের সবচেয়ে বড় হাড্ডিটি তো খুব খারাপভাবে ভেঙেছেই, পেট থেকে শুরু করে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত পুরো চামড়াটা খুলে গিয়েছে।

চর্বির স্তর উঠে গিয়ে থকথকে মাংস বেরিয়ে আছে, কুরবানির গরুর চামড়া ছাড়িয়ে মাংস বের করলে যেমন দেখা যায় ঠিক তেমন। এতো বিশাল একটা জায়গা জুড়ে। অজস্র রক্তপাত হচ্ছে, পেশেন্ট চলে গিয়েছে শকে।

পুরো টিম মিলে তাৎক্ষণিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা। একদিকে চলছে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা আরেকদিকে আমরা বালিমাখা জখম পরিষ্কার করছি–নরমাল স্যালাইন, হেক্সিস্ক্রাব, পভিডন আয়োডিন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দিয়ে ডলে ডলে। তারপর কেঁচি দিয়ে দ্রুত কেটে কেটে ফেলা হচ্ছে অবশিষ্ট চর্বি আর ইতোমধ্যে ‘নষ্ট’ হয়ে যাওয়া মাংসপেশিগুলো।

সিনিয়রের “এটা ফেল, এটা ফেল”–মানে হচ্ছে শরীরের পঁচে যাওয়া অংশগুলো কেটে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। হাত-পা ভরে যাচ্ছে রক্তে। রোগীকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে, আইসিইউতে ভর্তি দেওয়া হয়েছে। পরে খবর নিয়ে জানা গেলো তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

দিন তিনেক আগে এমনি করে আরেকজন এসেছিলেন মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করে। তরুণ ছেলে। কনুইয়ের আরও বেশ খানিকটা উপর থেকে হাতটা শুধু ঝুলে আছে। কিছুই করার ছিল না। পুরো হাতটা সঙ্গে সঙ্গে কেটে ফেলে দেওয়া হলো। উফফ… হাতুড়ি-বাটাল-করাত এসব দিয়ে চলতে থাকলো অপারেশানের কাজ।

আরেকজন খুব বেশি ছটফটে আর ওভার-কনফিডেন্ট ছেলে। হাত-পা ভেঙে ১ মাস শুয়ে ছিল। পেটের মধ্যে ফুটো করে মূত্রথলির মধ্যে ফুটো করে ঢোকানো ক্যাথেটার দিয়ে এখনও তাকে প্রস্রাব করতে হয়।

নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে এমন মোটরসাইকেল চালক অজস্রদিন ধরে শুয়ে থাকতে দেখি যারা কিছু চিনতে পারে না, কথা বলতে পারে না, মুখে খেতে পারে না, প্রাকৃতিক কাজগুলো বিছানাতেই করে। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে শরীরে দুর্গন্ধময় বড় বড় ঘাঁ হয়ে যায়। আহা কী অবর্ণনীয় কষ্ট তার আর তার সাথে থাকা আপনজনদের।

নায়ক রিয়াজের গল্প শুনেছি। তিনি বিমান চালাতেন। ছুটিতে এসে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। তার হঠাৎ মনে হলো এটা আর মোটরসাইকেল না, এটা তার চালানো বিমান। স্পিড বাড়িয়ে দিলেন, তিনি যেন উড়ছেন। এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। তিনি আর বিমান চালানোর কাজের জন্যে যোগ্য বলে বিবেচিত হননি।

অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সে মনের মাঝে অনেক বেশি এডভেঞ্চার আর থ্রিল কাজ করে। কুল ডুড হবার চেষ্টা থাকে৷ অস্বাভাবিক না। তরুণের মোটরসাইকেল চালানো যেন একটা ফ্যাশন। একটা বাইক না থাকলে যেন অনেকেরই বন্ধুমহলে মর্যাদা থাকছে না। কখনও কখনও মা-বাবারাও শখ করে কিনে দিচ্ছেন আবার কখনওবা ছেলে বাধ্য করছে কিনে দেবার জন্যে।

মোটরসাইকেলে ওঠার পর সে ছেলে আর নিজের মধ্যে থাকে না। সে যেন হয়ে যায় হলিউডের কোনো নায়ক। ডুবে যায় ফ্যান্টাসিতে। সামনের মানুষ, গাড়িঘোড়া, সিগন্যাল আর কিছুকেই যেন সে তোয়াক্কা করে না। যার ফলশ্রুতিতে পঙ্গু হাসপাতাল আর মেডিকেল কলেজগুলো ভরে যায় তাদের আহত ক্ষতবিক্ষত শরীরে। আচ্ছা যারা মোটরসাইকেল চালান তাদের কতোজনের লাইসেন্স থাকে?

তারা কি বোঝেন এমন একটা এক্সিডেন্টের পর তাদের মা-বাবার অবস্থাটা কী হয়? তারা মানসিকভাবে কী ভয়ানকভাবে ভেঙে পড়েন তা কি বুঝতে পারেন? ছেলের প্রতিনিয়ত এমন কষ্ট দেখে তাদের বুকটা কীভাবে খানখান করে ভাঙতে থাকে তা কি বোঝা যায়?

ছেলে শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়, আর লিটারেলি তারা মানসিক ও আর্থিকভাবে পঙ্গু হন। হ্যাঁ, পুরো পরিবারটাই পঙ্গু হয়। ধ্বংস হয়। আর সরাসরি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সংখ্যা তো অগুনিত। তাদের আমাদের সান্ত্বনা দেবার মতো কিছু থাকে না আর।

মা-বাবা একটু সাবধান হবেন কি? তরুণরা একটু মা-বাবার মুখের দিকে তাকাবে কি?

মোটরসাইকেল চালানো ছাড়াও তো স্মার্ট হবার, কুল ডুড হবার অজস্র পথ খোলা রয়েছে।

নিরাপদ সড়ক চাই। সচেতন চালক চাই।

লেখক:
ডা. মারুফ রায়হান খান
লেকচারার, ফার্মাকোলজি, এনাম মেডিকেল কলেজ