মোদি কিভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ব্যর্থ হয়েছেন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চার বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন, কিন্তু তার কর্মকাণ্ডের সফলতা নিয়ে ভারতের জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে। মানুষের মনে একটা ধারণা শক্ত ভাবে গেঁথে গেছে যে, মোদি গত চার বছর নির্বাচনী প্রচারণা, বিদেশ সফর অথবা সরকারী গণমাধ্যম ও নিজের অনলাইন অ্যাপে প্রচুর পরিমাণে নীতিকথা বলে কাটিয়েছেন।

মোদি প্রতি বছর দুই কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবে গত চার বছরে ১৫-২৪ বছর বয়সীদের উপযোগী ৭২ লক্ষ কর্মসংস্থান নষ্ট হয়েছে। ভারতে এখন নতুন কর্মসংস্থান তৈরির হার গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আবগারি শুল্ক দেয়া নিয়ে মধ্যবিত্তদের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। সারা দুনিয়ায় তেলের দাম কম হলেও গ্যাসোলিন ও ডিজেলের দাম ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে বেশি।

২০১৪ সাল থেকে সরকার গাড়ির তেলের উপর কর বসিয়ে ১৫ হাজার কোটি ডলার সংগ্রহ করেছে। জনগণের উপকার করার পরিবর্তে, ভারতের সরকার উল্টো তাদের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এর আগের মনমোহন সিংয়ের সরকার ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমার উপরে নিয়ে এসেছিল। তবে, বর্তমান সরকার দরিদ্রদের অবস্থা উন্নত করতে কিছু করবে কিনা এবিষয়ে কারও কোনও ধারণা নেই।

কৃষিজ পণ্য রপ্তানি মনমোহনের আমলে পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল, কিন্তু এখন তা ২১% কমে গেছে। একই সাথে কৃষি পণ্য আমদানি বেড়েছে ৬০%।

নতুন বিনিয়োগ গত ১৩ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে কম। বিভিন্ন ব্যবসার জন্য ব্যাংকগুলোর দেয়া ঋণের পরিমাণ গত ৬৩ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে কম, এবং ঋণের স্ফীতির হার ৫.১% কমেছে বলে জানিয়েছে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া।

পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৭৭ কোটি ডলারের জালিয়াতির ঘটনায় ভারতের ব্যাংকিং সেক্টরে দারুণ আঘাত হেনেছে। কিন্তু, জানুয়ারি মাসে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসের ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামে ভারতের ব্যবসা ও কর্পোরেট প্রতিনিধিদলের সদস্য নিরব মোদি তার ঋণ শোধ না করেই দেশ ছেড়েছেন। দেশ থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার আগে তাকে নরেন্দ্র মোদির সাথে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে দেখা গেছে।

ফেব্রুয়ারি ২০১৬-তে আরেক বিলিয়নিয়ার বিজয় মাল্য, যিনি মোদির বিজেপি দলের সহায়তায় সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনিও একই উপায়ে ১৪০ কোটি ডলার ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়ে সফলভাবে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান।

ভারতের অর্থনীতি লুটতরাজের এসব ঘটনা ঘটতে দেয়ায় মোদির সরকারের রেগে আছে।

অক্টোবর ২০১৭ সালে মোট অশোধ্য ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা জাতীয় ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ১২.৬%। জাতীয় ব্যাংকগুলোর

গত ৩৬ মাসে বিজেপি সরকার ৩,১০০ কোটি ডলার কর্পোরেট ঋণ মওকুফ করে দিয়েছে। কর্পোরেশনগুলোর প্রতি এই উদ্ভট উদারতা জনগণের অর্থায়নে ব্যাংকের নতুন পুঁজি সংগ্রহের মাধ্যমে পূরণ করা হয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে এর অর্থ হচ্ছে, কর্পোরেটদের লুটপাটের পর ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করেছে ভারতের সাধারণ জনগণ। একই সময়ে ভারতের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র কৃষক কৃষির দুর্দশার মধ্যে ঋণমুক্ত হতে প্রাণপণ সংগ্রাম করছে।

এসব ঘটনায়, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ ধীরে ধীরে ভারতের ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে সাধারণ মানুষ গত এক বছরে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে টাকা জমা রাখা উল্লেখযোগ্য হারে (প্রায় ৫০%) কমিয়ে দিয়েছে।

আরবিআইয়ের একটি বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাংক একাউন্টে নির্দিষ্ট অংকের কম অর্থ রাখার জন্য কর আরোপের নির্দেশ দেয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে এই বিজ্ঞপ্তির ফলে, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার গ্রাহকরা, যাদের বেশিরভাগই গরীব মানুষ, গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৬ কোটি ডলার কর দিয়েছে। এই টাকা নেয়া হয় দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতম মানুষদের কাছ থেকে, যাদের নিয়মিত আয় নেই, এবং বেশিরভাগ সময় তারা বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে নিজেদের টাকা তোলেন। ধনী ও পুঁজিবাদীদের বিশাল অংকের ঋণ মওকুফ করে দেয়ার থেকে এই চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

প্রতিবছর ১.২ কোটি যুবক ভারতের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। তাদের সবাইকে উপযুক্ত কাজ দিতে প্রতি বছর ভারতের অর্থনীতি ১০% বৃদ্ধি করতে হবে বলে জানিয়েছেন ভারতের সেন্ট্রাল ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রাঘুরাম রাজন। কিন্তু মোদি সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে কর্মসংস্থান তৈরি, কৃষিখাতে সংকট মোকাবেলা এবং দরিদ্রদের উন্নয়নে সহায়তায় ব্যর্থতা লক্ষণীয়।

মোদির ‘স্মার্ট-সিটি’ প্রজেক্ট, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রজেক্ট এবং অন্যান্য বহুল আলোচিত প্রজেক্টগুলোতে কী হচ্ছে তা কেউ জানেনা। একই সাথে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, সবার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা ও কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি।

ভারতের অনেকেই মনে করেন, মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করে দেশটি চার বছর নষ্ট করেছে। দুর্ভাগ্যবশত, মোদি পরিবর্তনের চালিকা শক্তি হয়ে ওঠার পরিবর্তে নিজেকে একজন সফল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বেশি সচেষ্ট ছিলেন।

[এশিয়া টাইমসে প্রকাশিত শচি শতপাঠির নিবন্ধ থেকে অনূদিত]