‘যারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না তাদের স্থান পাবনায়’

যারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় না তাদের স্থান পাবনায় হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। দেশের সব মানুষ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় দাবি করে তিনি বলেছেন, ‘এমন একটা লোক দেখান যে নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় না। যারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে না তাদের স্থান পাবনায় হতে হবে।’

শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি আয়োজিত ‘গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার : প্রেক্ষিত ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন।

ছাত্রদের উদ্দেশে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘তোমরা একবার সংবিধান দেখো। এই দেশের মালিক জনগণ। উত্তরসূরি হিসেবে কেউ না। বাঙালি যখন ন্যায্য দাবি নিয়ে লড়াই করে তখন তারা জয়ী হয়েছে, অপশক্তিরা পরাজিত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘জনগণ যদি ভোট দেয়ার সুযোগ পায় তাহলে সরকারকে স্মরণীয় শিক্ষা দেবে। আমার বিশ্বাস জনগণ খুবই সচেতন। তারা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সব বিষয়ে সচেতন থাকবে। কড়া নজর রাখবে। জনগণের হাত থেকে কোনো স্বৈরাচার রেহাই পায়নি। এরাও পাবে না।’

দেশের পরিস্থিতি এমন দিকে যাচ্ছে যে, নির্বাচন নাও হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। আর নির্বাচন হলে যেন ভোট চুরি না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। যারা নির্বাচনকে অন্যদিকে প্রভাবিত করে সুশাসনের পরিবর্তে কুশাসন সৃষ্টি করতে চায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এবং জেএসডির সভাপতি তানিয়া রব। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান ছিল বড় স্বৈরাচার। ১০ বছরের বেশি টেকেনি। দ্বিতীয় স্বৈরাচার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কত বছর টিকেছে? আশ্চর্যজনক, ১০ বছর টিকেছে। এখন যে স্বেচ্ছাচারী সরকার আছে তাদের মেয়াদও ১০ বছর। অনেক সহ্য করেছি, ১০ বছর হয়ে গেছে, এবার চলে যাও। আমার মনে হয়, এটাই আওয়ামী লীগের শেষ বছর।’

বি. চৌধুরী বলেন, ‘এক স্বেচ্ছাচারীর পরিবর্তে অন্য স্বেচ্ছাচারীকে আমরা ক্ষমতায় আসতে দেব না। যারাই গণতন্ত্রের পক্ষে, আমরা তাদের সঙ্গে থাকব। শুধু মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা ছিল আমরা তাদের সঙ্গে যাব না, এটা পরিষ্কার। আমরা চাই এ সরকার নির্বাচনকালীনের জন্য একটি নিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা করবে। আমরা নির্বাচন বর্জনের কথা বলি না, সরকারকে বাধ্য করব নিরপেক্ষ সরকারের ব্যবস্থা করতে।’

সাবেক এ রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমরা একটা কথা প্রায়ই শুনি, বাংলাদেশে নাকি ষড়যন্ত্রের রাজনীতি হচ্ছে। বিদেশিদের সঙ্গে বসে নাকি ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। দেশে একটি অন্যরকমের সরকার, সংবিধানের বাইরের সরকারের জন্য নাকি ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমরা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, আমরা কোনো ষড়যন্ত্রের অংশীদার নই। অসাংবিধানিক কোনো সরকারকে আমরা স্বীকৃতি দেব না। অগণতান্ত্রিক সরকারকে আমরা মেনে নেব না।’

ভোট চুরি এবং মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে সরকার ষড়যন্ত্র করছে- দাবি করে বি. চৌধুরী বলেন, ‘শেষ পর্যায়ে এসে কত লাখ বা কোটি ভুয়া ভোটার তারা তৈরি করেছে তা আমরা জানি না। আমরা ওইদিকে যাইনি। আমরা তো ইভিএম নিয়ে মেতে আছি।’

তিনি বলেন, ‘ইভিএমে দুই ধরনের ষড়যন্ত্র আছে। একটি হল- ভোট চুরির ষড়যন্ত্র। অপরটি হল- মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিয়ে রাত-দিন খালি ইভিএম নিয়ে পড়ে থাকা। ছেলেমেয়ে ও বাচ্চাদের ওপর যেসব জুলুম হয়েছে সেটা যেন মানুষ ভুলে যায় সে ব্যবস্থা করা’।

‘তরুণ ভোটাররা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে’- এমন ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে জনসংখ্যা রয়েছে পাঁচ কোটি ১৬ লাখ। ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে যে জনসংখ্যা তারা ভোটবঞ্চিত ছিল। এবার তারা প্রথম ভোট দেবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যারা আন্দোলন করল, তাদের রামদা, হাতুড়ি, লাঠি দিয়ে পেটানো হল। তাদেরই গ্রেফতার করা হল। যারা রামদা, হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছে তাদের তো গ্রেফতার করা হয়নি। এসব ছাত্রের মা-বাবা আছে, এরা ভোটার। তারা কি এ স্বৈরাচার সরকারকে ভোট দেবে?’

সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়ে বি. চৌধুরী বলেন, ‘সংসদ ভেঙে না দিলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। তাই নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে সংসদ ভেঙে দিতে হবে এবং নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ হতে হবে। সেই সঙ্গে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে হবে। সামরিক বাহিনীকে নির্বাচনের এক মাস আগেই ব্যবহার করতে হবে এবং তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হবে।’

দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলমকে গ্রেফতারের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শহিদুল আলমের গ্রেফতার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে যখন এক রকম কথা বলেন, আবার তার (প্রধানমন্ত্রী) ভাগ্নি মুক্তি চান- এসব দেখে আমরা বিব্রত হই। আমরা অবিলম্বে শহিদুল আলমের মুক্তি চাই।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘স্বৈরাচার সরকারের পরিণতি আমরা দেখেছি। যারা দুই নম্বরি, তিন নম্বরি করেছে, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে তাদের অবস্থান হয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ করে, বাংলাদেশের জনগণ কখনও পরাজিত হয়নি। বড় বড় স্বৈরাচার আমরা দেখেছি, কেউ তাদের চিরস্থায়ী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায় করতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘মানুষ যদি সঠিকভাবে ভোট দেয়ার সুযোগ পায়, যদি তারা নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে পারে, তাহলে আমি মনে করি বাংলার মানুষ ভুল করবে না। তরুণ সমাজকে ভোট পাহারা দেয়ার জন্য বোঝাতে হবে, যাতে জাল ভোট কেউ দিতে না পারে।’

সভাপতির বক্তব্যে আ স ম রব বলেন, ‘যুক্তফ্রন্ট-গণফ্রন্ট মিলে যে ঐক্য হয়েছে আমরা এটাকে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে নিয়ে যাব। স্বৈরাচার সরকার ও স্বাধীনতাবিরোধীরা ছাড়া বাংলাদেশের সবাইকে আহ্বান জানাব আমাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য।’

মাহমুদুর রহমান মান্নার বাসায় সিভিল ড্রেসে ডিবির (গোয়েন্দা পুলিশ) লোক যাওয়ার কথা উল্লে­খ করে তিনি বলেন, ‘সরকারবিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে যারা আছেন আগামীতে যদি তাদের কারও বাসায় হামলা করা হয়, পরিণতি ভালো হবে না, ভয়াবহ হবে। আমরা জবাব দেব।

আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘আমরা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ব্যবহার করা লোক। আমরা মাঠে নামব, ঘরে বসে থাকব না। মিছিল হবে, মিটিং হবে, অনুমোদন না দিলে বসে পড়ব। কোনো অনুমোদন নেব না। সংবিধানের কোথাও লেখা নাই মিছিল-মিটিংয়ের জন্য অনুমোদন নিতে হবে।’

মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ইভিএম মেশিন, যন্ত্রপাতির জন্য আগেই এলসি খুলে বসে আছেন। একনেকের অনুমোদন নাই, কোনো মন্ত্রিসভার বৈঠক নাই, কি করে এলসি খুললেন? কিভাবে অনুমোদন দিলেন? এটা ফোরটুয়েন্টির ব্যাপার। এরা সব লুটেরা, লক্ষ-লক্ষ, কোটি কোটি টাকা লুট করেছে। এটা একটা লুটের প্রকল্প। একই সঙ্গে টাকাও লুট করবে, ভোটও লুট করবে’।