যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তির পাঁচ বছরে কে কী পেল?

‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ (টিআইসিএফএ); সংক্ষেপে ‘টিকফা’। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের টিকফা চুক্তি একটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, যা আবারো আলোচনায় এসেছে।

গত ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ থেকে একটা বাণিজ্য প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটন রওনা হয়। বাংলাদেশ দলের নেতৃত্বে রয়েছেন বাণিজ্য সচিব সুভাশিষ বোস।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে থাকবেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত মার্কিন এসিসট্যান্ট ট্রেড রিপ্রেজেনট্যাটিভ মার্ক লিনসকট। ১৩ সেপ্টেম্বর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবার কথা। এই চুক্তির আওতায় এটা হলো চতুর্থ বৈঠক।

এর আগের বৈঠকটা হয়েছিল ২০১৭ সালের মে মাসে, ঢাকায়। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ঢাকায় প্রথম বৈঠক এবং ২০১৫ সালের নভেম্বরে দ্বিতীয় বৈঠক হয়েছিল। টিকফা চুক্তি থেকে কে কী পেল, তা আলোচনা করতে হলে এর ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে।

প্রায় এক দশক বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই চুক্তি স্বাক্ষরের আশা দেখানো হলেও শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের ঠিক আগে আগেই বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই চুক্তি স্বাক্ষর করে।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন মহলের বিরোধিতা থাকায় এই চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারছিল না সরকার। আর সাধারণ নির্বাচনের আগে আগে এই চুক্তি স্বাক্ষরকে অনেকেই তখন ভিন্ন চোখে দেখেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এ রকম সময়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরকে সমালোচনা করা হয়নি। বরং নির্বাচনের পরে যুক্তরাষ্ট্র নতুন সরকারের সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখে নতুন সরকারের প্রতি তাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থনেরই জানান দেয়।

২০১৩ সালের নভেম্বরে ‘আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ’ (এমচ্যাম)- এর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আফতাব-উল ইসলাম ‘টিকফা’ চুক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, এই চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে দু’দেশের মাঝে বাণিজ্যের সমস্যা এবং প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলোচনা করা।

তার মতে, এই চুক্তির সমঝোতা মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুলতবি করা ‘জিএসপি’ সুবিধা পুনর্বহাল করবে। একই সঙ্গে যে ৩ শতাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা দেয় না, সেগুলো নিয়েও আলোচনা করা সম্ভব হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের জুন মাসে মার্কিন ওবামা প্রশাসন বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল করে। এর আগ পর্যন্ত ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্য এই সুবিধার আওতায় থাকলেও তৈরি পোশাকের মতো সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোকে বাকি ৩ শতাশের মাঝে ফেলে এই সুবিধার বাইরে রাখা হয়।

টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর না করার পেছনে বাংলাদেশের অনেকেই পরিবেশ এবং শ্রম আইনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের উল্লেখ করেছিলেন। তাদের মতে, এই বিষয়গুলোকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপরে চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ পাবে। কেউ কেউ বলেছিলেন, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে পারার মতো আলোচক বাংলাদেশের আছে কিনা সন্দেহ, তাই এ রকম চুক্তি স্বাক্ষরে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে টিকফার সমর্থকেরা বলেছেন, এসব ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আরো কাছাকাছি গিয়ে একত্রে কাজ করলে এই সমস্যাগুলো থাকবে না। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি গেলে এসব ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সৃষ্টি কমবে, আর বাণিজ্য সুবিধা এবং বিনিয়োগ মিলবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশকে তাদের দেয়া শর্ত মেনেই চলতে হবে।

তবে ২০১৩ সাল থেকে মার্কিন তৈরি পোশাকের ক্রেতাদের সংগঠন ‘এলায়েন্স’ শ্রম-পরিবেশের উন্নয়নের ব্যাপারে বাংলাদেশের উপরে চাপ সৃষ্টি করলেও মার্কিন সরকার সেদেশে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশাধিকার সহজীকরণের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

ওয়াশিংটনে এবারের চতুর্থ বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রবেশাধিকার, প্রযুক্তির আদান-প্রদান এবং বাংলাদেশের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক এলাকাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করতে চায় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এবারের আলোচ্য বিষয়বস্তু থেকে জিএসপির বিষয়টাকে বাদ দেয়ায় কেউ কেউ মনঃক্ষুণ্ন হলেও এটা তারা উল্লেখ করেননি যে, ২০১৭ সালের বৈঠকেও বাংলাদেশ জিএসপি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। ২০১৭ সালের আলোচনার পরে সাংবাদিক সন্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটনের নতুন সরকার তাদের মুক্তবাজার নীতি অপরিবর্তিত রাখবে।

কিছুদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ’ মার্কিন সরকারের ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশন’র তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এক প্রতিবেদনে বলে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য বিক্রি করতে ২৩২ দেশের মাঝে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ শুল্ক দিতে হয়। তাদের হিসাবে, বাংলাদেশের প্রায় সকল পণ্যের উপরে গড়ে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ শুল্ক রয়েছে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শুল্ক আদায় করা হয় কম্বোডিয়ার কাছ থেকে (১৪ দশমিক ১ শতাংশ)। এরপর রয়েছে শ্রীলঙ্কা (১১ দশমিক ৯ শতাংশ), পাকিস্তান (৮ দশমিক ৯ শতাংশ), ভিয়েতনাম (৭ দশমিক ২ শতাংশ), চীন (২ দশমিক ৭ শতাংশ), জাপান ও জার্মানি (২ শতাংশ)।

গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে, যার ৯৫ শতাংশ ছিল তৈরি পোশাক, পাদুকা, টুপি এবং এ ধরনের পণ্য। বাংলাদেশের নিট পোশাকের উপর যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে; আর অন্য পোশাকের উপরে রয়েছে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। পাদুকার উপরে শুল্ক রয়েছে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। সংখ্যাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তবাজার নীতির পক্ষে সমর্থন যোগায় না। এই পণ্যগুলোর জন্যে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই জিএসপি সুবিধা দেয়নি। অন্য কথায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশের খুব কমই কাজে লেগেছে। বরং টিকফা চুক্তির মাধ্যমে তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক অধিকার বিষয়ে কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।

২০১২ সালে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসার পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের অবণতি হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সরকারকে অসন্তুষ্ট করে। গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহম্মদ ইউনূস বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটায়।

টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করে। সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের সময়েও ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস বেশ শক্তভাবে বাংলাদেশ সরকারের বিরোধী অবস্থান নেয়।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়ির উপরে সরকারপন্থীদের হামলাও হয় সে সময়। টিকফা চুক্তিকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের উপরে কতটুকু প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

শুরুতে বছরে কমপক্ষে একবার বৈঠকের কথা বলা হলেও পাঁচ বছরে মাত্র চারবার বৈঠক উভয় দেশের সম্পর্কোন্নয়নের দিকে উল্লেখযোগ্য কোনো মাইলস্টোন নয়। অপরদিকে ১৫ শতাংশ শুল্ক এবং পরিবেশ ও শ্রমিক অধিকারের ব্যাপারে বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টির কারণে বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেমন একটা সুবিধার আশা করা ছেড়েই দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের স্থবিরতার সুযোগে চীন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, কোরিয়া, ভারতের মতো দেশগুলোর জন্যে বাংলাদেশে ব্যবসার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য দেশ এক্ষেত্রে সুযোগ নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চালাচ্ছে।

বাংলাদেশ বিমানের জন্যে বোয়িং থেকে বিমান ক্রয়, শেভরনের বাংলাদেশে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া, এক্সেলেরেট এনার্জির এলএনজি টার্মিনাল এবং জেনারেল ইলেকট্রিকের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সেদিকেই আভাস দেয়।

চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের এক সেমিনারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ৮টি বিষয় তুলে ধরেন, যার মাঝে প্রথমটা ছিল ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন। পঞ্চম বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে ভারত, চীন, জাপান এবং ব্রিটেনের সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করেন।

এ থেকে এটা পরিষ্কার, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। একই সঙ্গে দু’দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে স্থবিরতার কারণে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নেবার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের ভালো খাতায় নেই। তবে উভয় দেশের একে অপরের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে যেসব চ্যানেলের মাধ্যমে তা প্রকাশ পাবে, তার একটা হলো টিকফা।