যেভাবে ধরা পড়লেন পালাতক ওসি মোয়াজ্জেম

ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে থানায় উত্তক্ত করার দায়ে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলায় সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় গত ২৭ মে। তাকে ধরতে ঢাকা, ফেনী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েও তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

রবিবার (১৬ জুন) দুপুরে তাকে শাহবাগ থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে শাহবাগ এলাকা থেকেই। গোয়েন্দা পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জামিনের জন্য হাইকোর্টে এসে পুলিশের কাছে ধরা পড়েছেন মোয়াজ্জেম।

এদিকে সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতারের বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, ‘আমরা শাহবাগ থানা এলাকা থেকে পুলিশ পরিদর্শক মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করেছি। তাকে শাহবাগ থানায় রাখা হয়েছে।’

তবে তাকে ঠিক কোন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি ওসি। শাহবাগ থানা পুলিশেরই আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, হাইকোর্টের সামনে থেকে বিকেল ৩টার দিকে গ্রেফতার করা হয় মোয়াজ্জেমকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশ পরিদর্শক মোয়াজ্জেম হোসেনের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেও একই তথ্য পাওয়া গেছে।

গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের চারটি টিম নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। তাদের কাছে তথ্য ছিল, মোয়াজ্জেম গত কয়েকদিন ধরে কুমিল্লায় অবস্থান করছেন। সেই তথ্য অনুযায়ী গত চার দিনে কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা।

মোয়াজ্জেমের বিষয়ে ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত চার দিন ধরে কুমিল্লা শহর, মুরাদনগর, দেবিদ্বার ও দাউদকান্দি, এই চার এলাকায় মোয়াজ্জেমের শ্যালিকা, বন্ধু, খালাত বোন ও গাড়িচালকের বাসায় অভিযান চালিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। আমাদের কাছে তথ্য ছিল, এই প্রতিটি স্থানেই মোয়াজ্জেম অবস্থান করেছে। কিন্তু অভিযানে তাকে ধরা সম্ভব হয়নি।

নাম প্রকাশে ইচ্ছুক গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা খবর পাই, আজ (রবিবার) মোয়াজ্জেম জামিন নিতে হাইকোর্টে আসবেন। সে কারণে আমরা হাইকোর্টে তৎপর ছিলাম। তবে তিনি কোন আইনজীবীর দ্বারস্থ হবেন, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল না। ফলে হাইকোর্টের প্রতিটি আইনজীবীর চেম্বার আমাদের খুঁজে দেখতে হয়েছে। গোটা এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছিল। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েই শেষ পর্যন্ত মোয়াজ্জেম হাইকোর্টের বাইরে বের হতে বাধ্য হয়। আর সেখান থেকেই শাহবাগ থানা পুলিশ গ্রেফতার করে তাকে।

কুমিল্লার মুরাদনগরে থাকেন মোয়াজ্জেম হোসেনের খালাত ভাই খায়রুল ইসলাম মিনহাজ বলেন, (রোববার) সকাল ১০টায় জামিন আবেদন নিয়ে অ্যাডভোকেট সালমা ইসলামের মাধ্যমে হাইকোর্টে ২৫ নম্বর কোর্টে হাজির হন মোয়াজ্জেম। আদালত জামিন শুনানির জন্য আগামীকাল সোমবার (১৭ জুন) তারিখ নির্ধারণ করেন। পরে হাইকোর্ট এলাকা থেকেই তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

মোয়াজ্জেমের দীর্ঘ দিনের গাড়িচালক বলেন, মোয়াজ্জেমের ফোন পেয়ে সকালে কুমিল্লা থেকে ঢাকা এসেছেন। আসার পর থেকেই মোয়াজ্জেমের সঙ্গে ছিলেন তিনি। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।

উল্লেখ্য, অধ্যক্ষের কাছে শ্লীলতাহানির শিকার হয়ে থানায় অভিযোগ দিতে গিয়েছিলেন সোনাগাজী ইসলামিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি। ওই সময় নুসরাতের জবানবন্দি ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম। থানায় নুসরাতকে হয়রানির এ ঘটনায় ঢাকার সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে বাদি হয়ে মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।

আদালত মামলাটির তদন্ত ভার দেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। পরে গত মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা তুলে ধরে ২৭ মে পিবিআইয়ের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে আদালত মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

সাময়িক বরখাস্ত করার পর মোয়াজ্জেমকে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি অফিসে সংযুক্ত করা হয়। সেখানেও পাঠানো হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। তবে মোয়াজ্জেম সেখানে যোগ না দেওয়ায় সেখান থেকেও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।

এর আগে, নুসরাত থানায় গিয়ে ওসি মোয়াজ্জেমের কাছে হয়রানির শিকার হলেও পরে তার মা নুসরাতের মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, সিরাজকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় নুসরাতের মা বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন।

এরপর থেকেই সিরাজ কারাগারে রয়েছেন। তবে কারাগার থেকেই তিনি নুসরাতের পরিবারের ওপর মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। নুসরাতের পরিবার মামলা তুলে না নিলে সহযোগীদের দিয়ে ৬ এপ্রিল গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষের সহযোগীরা। গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় নুসরাতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল না ফেরার দেশে পাড়ি জমান নুসরাত।