যেসব কারণে সিরিয়ায় মার্কিন হামলার জবাব দেয়নি রাশিয়া

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সপ্তাহব্যাপী হুমকি-ধামকি বিনিময়ের পর শনিবার সত্যি সত্যিই সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যৌথভাবে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির তিনটি সম্ভাব্য স্থানে হামলা চালায়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তর্জন-গর্জনের তুলনায় হামলার কার্যকারিতা নগণ্যই বলতে হবে। কতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যে আঘাত হানতে পেরেছে সে সম্পর্কে যে বিভিন্ন রকম রিপোর্ট পাওয়া গেছে, তা উপেক্ষা করলেও এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সিরিয়ার সামরিক বাহিনীরও কোনো বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সম্প্রতি ইসরাইল সিরিয়ার টি-ফোর বিমানঘাঁটিতে হামলা চালানোয় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার তুলনায় এটা সামান্য।

এক হিসেবে দেখতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের আক্রমণে ২০১৭ সালে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার চেয়ে ভিন্ন কিছু ঘটেনি। ওই সময়ে সিরিয়ার সরকারবিরোধী পক্ষের ওপর রাসায়নিক হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র শায়রাত বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে।

কিন্তু এই বছর হামলা করার আগে ওয়াশিংটন সিরিয়ার পাশপাশি তার মদদদাতা রাশিয়াকেও রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের জন্য দায়ী করে। একারণে পরিস্থিতি অনেক উত্তেজনাপূর্ণ ছিল এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

এই সম্ভাবনা আপাতত এড়ানো গেছে, এবং পুরো হামলাটিকে কেবল ‘লোক দেখানো’ বলে মনে করা হচ্ছে।

আসাদের সন্তুষ্টি

সাম্প্রতিক হামলায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে সিরিয়ার সরকার ও তার সহযোগী দেশগুলো। হামলার ফলে ভূমিতে ক্ষমতার ভারসাম্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি, এবং সরকারের অনুগত বাহিনীর কোনো ক্ষতি হয়নি।

হামলার কয়েক ঘণ্টা পর, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ একটি ভিডিও প্রকাশ করে সামাজিক গণমাধ্যমের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন, যেখানে তাকে দামেস্কে নিজের কর্মক্ষেত্রে বিজয়ীর বেশে বসে থাকতে দেখা যায়। স্থানীয় ও বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে রাস্তায় উল্লাসরত সিরিয়ার সাধারন মানুষের ছবি প্রচার করা হয়।

আসাদ গণমাধ্যমের ঝড়ও ভালোভাবেই সামাল দিয়েছেন। গতবছর যুক্তরাষ্ট্র শায়রাতের বিমানঘাঁটিতে হামলা করলে মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়েছিল এবং মিডিয়া আরো নতুন হামলার সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছিল। কিন্তু এবার ট্রাম্প যাকে ‘নিখুঁত হামলা’ বলে অভিহিত করছেন সেটির পর একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে- ট্রাম্পের ভাষণে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টার বেশি কিছু নেই।

আসাদের কাছে এটা পরিষ্কার যে, সিরিয়ার বিরোধ নিষ্পত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কৌশল নেই এবং রাসায়নিক হামলা বন্ধেও তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম নয়।

হাবভাব বুঝছিল রাশিয়া

গত বছর রাশিয়ার নেতারা মনে করেছিলেন, ট্রাম্প তার দেশে যেসব আভ্যন্তরীণ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন তার সবচেয়ে সহজ সমাধান হিসেবে শায়রাত বিমানবন্দরে হামলা করেছেন।

এই বছরও মস্কো মনে করছে, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা দুমায় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের জবাব ছিল না, এবং এটা সিরিয়ার দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায় নয়। এটা শুধুই শক্তির প্রদর্শনী।

এছাড়াও, আক্রমণ চালাতে ওয়াশিংটন যে পরিমাণ সময় নিয়েছে তা দুর্বলতা ও সিদ্ধান্তহীনতারই প্রমাণ। এতে রাশিয়ার নেতারা আত্মবিশ্বাসীই হয়েছেন। ফলে, ওয়াশিংটন হামলায় করে মাটিতে রাশিয়ার সম্পত্তির কোনো ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকায় মস্কো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শুধু আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগের সপ্তাহে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এই মন্তব্য আদান-প্রদান চালিয়ে গেছে। মস্কো যে সমন্বয় বিধানের ওপর আস্থাশীল ছিল বুঝা গেছে হামলার দিন দামেস্কে ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল আন্দ্রেই টুরচাকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে।

সিরিয়ায় এই ‘আনুষ্ঠানিক’ আঘাত দুমায় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের ফলে দুই দেশেই বিরাজমান উত্তেজনা প্রশমনের সবচেয়ে ভালো উপায়। মস্কো সিরিয়ায় স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রেখেছে, এবং ওয়াশিংটনও তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে একটি ‘আদর্শগত’ অবস্থান ধরে রেখেছে।

পাল্টা পদক্ষেপে হিসেবে আঘাত হানার ‘ছল’ এবং ইসরাইলের বিমান হামলা

কিন্তু হামলার আগে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের কী দরকার ছিল?

রাশিয়া ২০১৫ সালে সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ শুরুর পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু। চলতি বছর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার বাৎসরিক ভাষণে রাশিয়ার ওপর হামলা করা হলে ‘তাৎক্ষণিক জবাব’ দেয়া হবে বলে হুমকি দিলে এই সংঘর্ষের ঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পায়।

যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় হামলা চালানোর আগ মুহূর্তেও পাল্টা হামলার হুমকি দেয়া হয়েছিল। রাশিয়ার চিফ অব জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ বলেন, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সদস্যরা হুমকির মুখে পড়লে ‘ক্ষেপণাস্ত্র ও সেগুলো বহনকারী যানে’ পাল্টা হামলা চালাবে রাশিয়া।

কিন্তু গত বছরের মতই এবছরও যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর পর কার্যত কিছুই হয়নি। কারণ রাশিয়ার সেনাবাহিনীর কোনো ক্ষতি হয়নি। মস্কোর কাছ থেকে এর চেয়ে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া আশা করাটা হবে অপরিণামদর্শিতা। আবেগপূর্ণ বক্তব্যের রাশিয়ার নেতারা কোনভাবে সীমা অতিক্রম করে সংঘর্ষে জড়াতে চাইছেন না।

সামরিকভাবে অধিকতর শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটবাহিনীকে সরাসরি মোকাবেলা করতে গেলে সিরিয়ায় রাশিয়া সম্পূর্ণ পরাস্ত হবে। বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র লড়াইও শুরু হয়ে যেতে পারে, এটা বলাই বাহুল্য।

অতএব এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে, রাশিয়া সিরিয়ায় ইসরাইলের একাধিক হামলার কোনো জবাব দেয়নি। গত ছয় মাস ধরে ইসরাইল নিয়মিত সিরিয়ার বিভিন্ন স্থাপনাও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে।

গত সেপ্টেম্বরে, ইসরাইলের যুদ্ধবিমান সিরিয়ার হামা প্রদেশের একটি অস্ত্র নির্মাণ কারখানায়, একমাস পর দামেস্কের কাছে একটি বিমান বিধ্বংসী দলের ওপর এবং ডিসেম্বরে একটি অস্ত্রাগারে হামলা চালায়।

এবছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ইসরাইলি বিমান বাহিনী সিরিয়ার বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত সিরিয়া ও ইরানের সামরিক ঘাঁটিতে আঘাত হানে। সর্বশেষ এপ্রিল ৯ তারিখে তারা হমস প্রদেশের টি-ফোর বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ইরানের কয়েকজন সৈন্যকে হত্যা করে।

এসব হামলার সময় রাশিয়ার বিমান হামলা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যার মধ্যে রয়েছে এস-৩০০, এস-৪০০ ও প্যান্টসির একবারও ইসরাইলের যুদ্ধবিমানকে আক্রমণ করেনি।

অতএব এটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, রাশিয়া অনমনীয় বক্তব্য দিয়ে মাটিতে কোনো ঝুঁকি না নেয়ার কৌশল গ্রহণ করেছে।

এত কিছুর পরও ময়দানে যুদ্ধের তোড়জোড়ের অভাব দেখা গেলেও, বাকযুদ্ধের উত্তেজনা খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দুই পক্ষের লোকজনের আচরণের মধ্যেই একটা অনিশ্চয়তা বা অনুমান করা যায় না এমন কাজের প্রবণতা দেখা গেছে।

একইসঙ্গে, তারা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য রীতি ও কার্যপ্রণালী উপেক্ষা করেছেন। ভবিষ্যতে এগুলো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, কারণ এতে আলোচনা ও কূটনৈতিক সমাধানের সুযোগ কমে যায়।

(আলজাজিরার মতামত বিভাগে প্রকাশিত লিওনিড ইসায়েভের নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ মামুনূর রশিদ। লিওনিড ইসায়েভ মস্কোর হাইয়ার স্কুল অফ ইকনমিক্সের প্রভাষক।