যে কারণে বাস ড্রাইভাররা এত বেপরোয়া

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গণ-পরিবহনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য কঠিন হবে বলে মনে করছেন সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে আন্দোলনকারীরা।

তারা বলছেন, রাজনীতি এবং চাঁদাবাজির কারণে সরকারের এই ধরনের উদ্যোগ অতীতে ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে থেকেই নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে।

পাশাপাশি এই খাতে প্রশিক্ষিত ড্রাইভার না থাকা এবং চুক্তি ভিত্তিতে ড্রাইভারের হাতে বাস ছেড়ে দেয়ার জন্যই সড়কে নানা দুর্ঘটনা ঘটছে বলে পরিবহন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।

সম্প্রতি ঢাকায় বাসচাপা পড়ে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর রাজধানী জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভের পটভূমিতে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এক বৈঠক হয়।

এতে প্রধানমন্ত্রী মুখ্য সচিব ছাড়াও সড়ক পরিবহন, বিআরটিএ, বিআরটিসি এবং পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ঐ বৈঠক থেকে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

এই বিষয় নিয়ে বিবিসির সাথে আলাপকালে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের নেতা অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, অতীতে এধরনের সাময়িক ব্যবস্থার কথা বলে সড়ক নিরাপত্তার ওপর বৈধ আন্দোলন থামিয়ে দেয়া হয়েছে।

“সরকার কঠোর হতে চাইলেও, বাস-ট্রাকের মালিক ও শ্রমিকরা এ নিয়ে হরতাল শুরু করেন। ভাঙচুর করেন। ফলে সরকার ভয় পেয়ে যায়,” তিনি বলেন, “সরকারের ভেতরে থাকা পৃষ্ঠপোষকদের জন্যই বাস মালিক এবং ড্রাইভাররা আজ এতটা বেপরোয়া আচরণ করছে।”

ওদিকে বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে মঙ্গলবার ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভের মধ্যে পরিবহন মালিকরা সড়ক থেকে বাস উঠিয়ে নেন।

এর ফলে সাধারণ যাত্রীরা চরম হেনস্থার মধ্যে পড়েন।

সরকারি হিসেব মতে, সারা দেশে ৩২ লক্ষ গাড়ির সরকারি নিবন্ধন রয়েছে। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে ২৫ লক্ষের। অর্থাৎ বিশাল সংখ্যক ড্রাইভার কোন অনুমতি ছাড়াই গাড়ি নিয়ে পথে নামছেন।

এই ব্যবধানের কারণ ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের সড়ক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক শেখ মো. মাহাবুব-ই-রব্বানী বলছেন, বাস-ট্রাকের মতো ভারী গাড়ির লাইসেন্স নিতে মোট ছয় বছর সময় লাগে।

ড্রাইভারদের প্রথমে হালকা গাড়ির লাইসেন্স নিতে হয়, তার তিন বছর পর মাঝারি গাড়ির লাইসেন্স নিতে হয়। ভারী গাড়ির লাইসেন্সের জন্য আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়।

এরপর যে ড্রাইভার বাস চালাতে চান তাকে পাবলিক সার্ভিস ভেহিকেল অথোরাইজেশন বা পিএসভি নামে ভিন্ন আরেকটি লাইসেন্স নিতে হয়ে।

“অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ড্রাইভাররা এতটা সময় অপেক্ষা করতে চান না। তারা হালকা বা মাঝারি গাড়ির লাইসেন্স ব্যবহার করেই বাস চালান,” শেখ মো. মাহবুব-ই-রব্বানী বিবিসিকে বলেন।

আর মালিকরাও তাদের মুনাফার স্বার্থে এটা মেনে নেন। দক্ষ ড্রাইভার না থাকার কারণেই বাসের হেলপাররাও এক সময় ড্রাইভিং সিটে বসার সাহস দেখায় বলে তিনি জানান।

পরিবহন মালিকদের দৃষ্টিভঙ্গি এই খাতের একটি বড় সমস্যা বলেও সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনকারী উল্লেখ করেন।

মালিকরা প্রায়শই প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকার বিনিময়ে তাদের বাসকে ড্রাইভারের হাতে তুলে দেন।

সমস্যার কথা স্বীকার করলেন বিআরটিএ পরিচালক শেখ মো. মাহাবুব-ই-রব্বানী।

“এই ধরনের কন্ট্রাক্ট থাকায় বাস ড্রাইভার বেশি সংখ্যক ‘ট্রিপ মারতে’ চান, কারণ বাস মালিকের চাহিদা পূরণের পর তাকে প্রতিদিন আয়ের টাকা জোগাড় করতে হয়,” তিনি বলেন, “এর জন্যই তারা রাস্তায় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায়।”

ওদিকে গণপরিবহণকে ঘিরে ক্ষোভ-বিক্ষোভের ঢেউ ছুঁয়েছে বাংলাদেশের আদালতেও।

দেশটির হাইকোর্ট সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার লক্ষ্যে মঙ্গলবার যানবাহনের ফিটনেস জরিপে একটি নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করার আদেশ দিয়েছে। জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের শুনানিতে আদালত এই আদেশ দেয়।

সূত্র : বিবিসি বাংলা