যে কারণে বিশ্বকাপে ভারতের সঙ্গে পারে না পাকিস্তান!

আর কিছুক্ষণ পরই ওল্ড ট্রাফোর্ডে শুরু হতে যাচ্ছে ভারত-পাকিস্তান মহারণ। দুই বৈরি প্রতিবেশীর এই স্নায়ুক্ষয়ী যুদ্ধের আগে একটা প্রশ্নই ঘুরছে, বিশ্বকাপে ভারতের সঙ্গে কেন পারে না পাকিস্তান?

ওয়ানডে ক্রিকেটে দুই দেশের মুখোমুখি দ্বৈরথে এখনো যোজন এগিয়ে পাকিস্তান। এ পর্যন্ত খেলা মোট ১৩১টি ওয়ানডের মধ্যে ৭৩টিতে জিতেছে পাকিস্তান। বিপলীতে ভারত জিতেছে মাত্র ৫৪টিতে। কিন্তু, বিশ্বকাপ মঞ্চ হলেই যেন কি হয়ে যায় পাকিস্তানিদের। ভারতীয়দের কাছে পাত্তাই পায় না।

বিশ্বকাপে এর আগে মোট ৬ বার একে অন্যের মুখোমুখি হয়েছে দুই প্রতিবেশী। সেই ৬ ম্যাচেই জিতেছে ভারত। পাকিস্তান কোনো ম্যাচে ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়তে পারেনি। কেন বিশ্বকাপের ম্যাচে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানিদের এই অসহায় আত্মসমর্পণ? আজকের ওল্ড ট্রাফোর্ড ম্যাচকে সামনে রেখে এই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে বের করার চেষ্টায় নামে পাকিস্তানি গণমাধ্যম।

মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেই চেষ্টায় সফলও হয়েছে পাকিস্তানি মিডিয়া। খুঁজে বের করেছে বিশ্বকাপে ভারতের কাছে পাকিস্তানিদের না পারার কারণ। খুব বেশি না, অনেক খুঁজে পেতে মোট ৪টি কারণ আবিষ্কার করেছে তারা। এক. টস জিততে না পারা। দুই. খেলতে নেমে রক্ষণাত্মক মনোভাব প্রদর্শন। তিন. স্নায়ুক্ষয়ী চাপ সামলাতে না পারা এবং চার. বাজে ফিল্ডিং।

বিশ্বকাপে দুই দলের ৬টি ম্যাচের পরিসংখ্যান ঘেটেই এই কারণগুলো খুঁজে বের করেছে পাকিস্তানি গণমাধ্যম। আবহাওয়া, কন্ডিশন বিবেচনায় ওয়ানডেতে অনেক সময়ই টস জয়টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কিন্তু, বিশ্বকাপে খেলা দুই দলের ৬ ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটিতে টস জিততে সক্ষম হন পাকিস্তানি অধিনায়কেরা। বাকি ৫ ম্যাচেই টস জিতেছে ভারতীয় অধিনায়কেরা। তার ফলও তারা ঘরে তুলেছে।

তাছাড়া দুই ক্রিকেট দ্বৈরথ মানেই স্নায়ুক্ষয়ী চাপ। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধাংসী মানসিকতার কারণে চাপটা আরও বেশি। পাকিস্তানি গণমাধ্যমের দাবি, চিরশত্রু ভারতের বিপক্ষে মহা সেই চাপটাই ভালোভাবে সামলাতে পারে না পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা। মাঠে নেমে চাপের মুখে ভেঙে পড়ে। তার প্রভাব পড়ে ম্যাচের ফলে।

আর এই চাপের কারণেই কিনা, বিশ্বকাপে ভারতের মুখোমুখি হলেই নাকি পাকিস্তানিরা অতি-রক্ষণাত্মক কৌশল অবলম্বন করে থাকে এবং সেই রক্ষণাত্মক কৌশলই শেষ পর্যন্ত ডোবায় তাদের। নিজেদের দাবির পক্ষে বিশ্বকাপে দুই দলের ৬ ম্যাচের স্কোরকার্ডও সংক্ষেপে তুলে ধরেছে পাকিস্তানি গণমাধ্যম।

১৯৯২ বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপে দুই বৈরি প্রতিবেশী প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয় ১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে। গ্রুপপর্বের সেই ম্যাচে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং নেয় ভারত। শচীন টেন্ডুলকারের ৫৪ রানের ইনিংসে ভর করে ভারত গড়তে পারে মাত্র ২১৬ রানের পুঁজি।

অতি-রক্ষণাত্মক কৌশলের কারণে ২১৭ রানের মামুলি এই লক্ষ্যটাই পাকিস্তানিদের জন্য হয় হিমালয়সম! মাত্র ১৭৩ রানে অলআউট হয়ে পাকিস্তান ম্যাচ হারে ৪৩ রানে! ম্যাচটিতে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানরা কতটা রক্ষণাত্মক ছিল, সেটি একটি তথ্যেই স্পষ্ট। দলের সবচেয়ে বড় ব্যাটসম্যান জাভেদ মিয়াঁদাদ খেলেন ১১০ বলে ৪০ রানের ইনিংস!

১৯৯৬ বিশ্বকাপ

বেঙ্গালুরুর এই ম্যাচটি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ ছিল। প্রথমে ব্যাট করে ভারত গড়ে ২৮৮ রানের বিশাল পুঁজি। জবাবে পাকিস্তান শুরু করেছিল ঝড়ের গতিতে। আমির সোহেল ও সাঈদ আনোয়ার মিলে উদ্বোধনী জুটিতে ভারতীয় বোলারদের তুলোধুনো করতে শুরু করেন। কিন্তু, এই মার কাটারি ব্যাটিং করার ফাঁকে মাঠেই অহঙ্কার প্রকাশ করেন আমির সোহেল।

ভারতীয় পেসার ভেঙ্কটেশ প্রসাদকে একটা চার মারেন আমির সোহেল। বীরদর্পে শটটি খেলার পর পাকিস্তানি ওপেনার গর্ব করে প্রসাদকে বলের গতিপথ দেখিয়ে দেন এবং ব্যঙ্গ করে প্রসাদকেই সীমানা থেকে বলটি কুড়িয়ে আনার ইঙ্গিত করেন। আমির সোহেলের এই দাম্ভিক আচরণে গ্যালারিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিধি বাম, প্রসাদের ঠিক পরের বলেই আউট হন আমির সোহেল। অহঙ্কারে পতন! সোহেলের সেই বিদায়ের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানও ধীরে ধীরে ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত হারে ৩৯ রানে।

১৯৯৯ বিশ্বকাপ

ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে দুই দলের সাক্ষাৎটা ছিল সেমিফাইনালে। প্রথমে ব্যাট করে ভারত রাহুল দ্রাবিড় (৬১) ও অধিনায়ক আজহার উদ্দিনের (৫৯) হাফসেঞ্চুরিতে ভর করে মাত্র ২২৭ রানের পুঁজি গড়ে। জবাবে অতি-রক্ষণাত্মক কৌশলের আশ্রয় নেয়া পাকিস্তান মাত্র ১৮০ রানেই অলআউট হয়ে ম্যাচ হারে ৪৭ রানে! মজার ব্যাপার হলো, এবারও পাকিস্তানিদের দুঃস্বপ্নের নায়ক ছিলেন সেই প্রসাদ। পাকিস্তানকে প্যাকেট করতে ভারতীয় পেসার মাত্র ২৭ রান দিয়ে নেন ৫ উইকেট।

২০০৩ বিশ্বকাপ

এই বিশ্বকাপেই ভারতের বিপক্ষে একমাত্র টসটা জিতে পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাটিং করে সাঈদ আনোয়ারের দুর্দান্ত সেঞ্চুরির সুবাদে ২৭৩ রানের বিশাল পুঁজিও গড়ে পাকিস্তান। কিন্তু, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, শোয়েব আখতারদের মতো তারকা বোলাররাও এই পুঁজিটাকে জয়ের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ করতে পারেননি।

শচীন টেন্ডুলকার ও যুবরাজ সিংয়ের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে অনায়াসেই জয় তুলে নেয় পাকিস্তান। পাকদের হতাশায় পুড়াতে টেন্ডুলকার খেলেন ৭৮ বলে ৯৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। তবে বোলাররা নন, পাকিস্তানি গণমাধ্যমের দাবি, দক্ষিণ আফ্রিকায় পাকিস্তানের হারটা আসলে ছিল বাজে ফিল্ডিংয়ের ফসল।

২০১১ বিশ্বকাপ

শুধু বাজে ফিল্ডিংই যে একটা দলের হাতের মুঠো থেকে একটা ম্যাচ বের করে নিতে পারে, ২০১১ বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচটি তার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। এবারের দ্বৈরথটাও ছিল সেমিফাইনালে। টস জয়ী ভারত প্রথমে ব্যাট করে গড়ে ২৬০ রানের পুঁজি।

পাকিস্তানি গণমাধ্যমের দাবি, এর মধ্যে অন্তত ৪০ রানই ভারত পায় পাকিস্তানিদের বাজে ফিল্ডিংয়ের কারণে। ম্যাচে সর্বোচ্চ ৮৫ রানের ইনিংস খেলা এক টেন্ডুলকারকেই ৪-৫ বার জীবন দেয় পাকিস্তানি ফিল্ডাররা। বাজে ফিল্ডিংয়ের মাশুল হিসেবেই পাকিস্তান ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত হারে ২৯ রানে।

২০১৫ বিশ্বকাপ

অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের এই বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি হয় ভারত-পাকিস্তান। টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং করা ভারত বিরাট কোহলির ১০৭ রানের ইনিংসে চড়ে কাটায় কাটায় ৩০০ রানের পুঁজি গড়ে। জবাবে ভারতীয় বোলারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের মুখে মাত্র ২২৪ রানেই অলআউট হয়ে যায় পাকিস্তান। বলা হয়, এই ম্যাচটিতে নিজেদের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে দল নিয়ে মাঠে নামে পাকিস্তান! ৭৬ রানের হারটা সেই অনভিজ্ঞতারই ফসল মনে করা হয়।