যে ব্যক্তিকে ছয় বছর বয়স থেকে আটকে রেখেছে চীন

তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ছয় বছর বয়সে, ১৯৯৫ সালে আটক করে চীনের কর্তৃপক্ষ।

তাকে বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী রাজনৈতিক বন্দি বলে মনে করা হয়।

এরপর ২৪ বছর পার হয়ে গেলেও তাকে আর জনসম্মুখে দেখা যায়নি। আর এই ব্যাপারটি এই ধর্মকে একটি জটিলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

কেন তাকে আটক করা হয়?

তিব্বতের বুদ্ধরা পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন। যখন এই ধর্মের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ গুরু পাঞ্চেন লামা ১৯৮৯ সালে রহস্যজনক কারণে মারা যান (অনেকে মনে করেন যে, চীনা সরকার তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছে), তখন তার পুনর্জন্ম ছিল কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

১৯৯৫ সালের ১৪ই মে তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর প্রধান গুরু দালাই লামা ঘোষণা দেন যে, পাঞ্চেন লামার নতুন দেহধারীকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন।

সে হলো তিব্বতের নকচু শহরের একজন চিকিৎসক ও সেবিকা দম্পতির ছয় বছরের ছেলে গিনডু চোকি নিমা।

চীনের সরকার আশা করছিল, দালাই লামার সহযোগিতা ছাড়াই নতুন পাঞ্চেন লামাকে খুঁজে পাওয়া যাবে, যিনি ১৯৫৯ সালে তিব্বত ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখানে প্রবাসী তিব্বতি সরকার গঠন করেন।

সুতরাং গিনডু চোকি নিমা এবং তার পরিবারকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় চীন এবং কিছু অনুগত বুদ্ধ নেতাদের সহায়তায় আরেকটি ছেলেকে পুতুল পাঞ্চেন লামা হিসাবে নির্বাচিত করে।

এরপরে যা হয়

১৯৯৫ সালের ১৭ই মে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আর জনসম্মুখে দেখা যায়নি গিনডু চোকি নিমাকে।

সাউথ চায়না মনিং পোস্টকে একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি এখন চীনের উত্তরাঞ্চলের গ্যানসুতে বসবাস করেন। আরেকটি ধারণা হলো যে, তাকে বেইজিং এর আশেপাশে কোথাও আটকে রাখা হয়েছে।

২০০০ সালের অক্টোবরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন কুক হাউজ অফ কমন্সের বৈদেশিক সম্পর্ক নির্ধারণ কমিটিকে বলেছেন, ”যতবার আমরা গিনডু চোকি নিমার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছি, চীনের সরকার আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, তিনি সুস্থ শরীরে রয়েছেন এবং তার যত্ন নেওয়া হচ্ছে। তবে তার পিতামাতা এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ চান না।”

”গত সপ্তাহের সর্বশেষ বৈঠকে তারা দুইটি ছবি দেখিয়েছে, যাতে আমরা গিনডু চোকি নিমাকে তার বাড়িতে রয়েছেন বলে দেখানো হচ্ছে। তবে এগুলো আমরা নিজেরা যাচাই করে দেখতে পারিনি।”

২০০০ সালে ওই বালকের বয়স হওয়ার কথা ১১ বছর। একটি ছবিতে দেখা গেছে সে টেবিল টেনিস খেলছে। আরেকটি ছবি তার পেছন দিক থেকে তোলা, যেখানে সে ব্লাকবোর্ডে চীনা ভাষায় কিছু লিখছে। ছবিগুলো দেখানো হলেও সেগুলো হস্তান্তর করা হয়নি।

সর্বশেষ ছবি কোথা থেকে আসছে?

এই লেখার শুরুর ছবিটি এসেছে ফরেনসিক শিল্পী টিম উইডেনের বয়স-অগ্রগতি ভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। দালাই লামার অনুসন্ধানী দল ১৯৯৪-৯৫ সালে গিনডু চোকি নিমাকে খুঁজে বের করার পর যে ছবি তোলে, সেটিই তার একমাত্র ছবি।

পাঞ্চেন লামার ৩০তম জন্মদিন উপলক্ষে ওই ছবিটিকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমান চেহারা বের করার চেষ্টা করেছেন টিম উইডেন।

সাধারণত নিখোঁজ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যেখানে অনেক ছবি, বাবা-মা বা ভাই-বোনদের চেহারা বিবেচনায় নেওয়া হয়।

কিন্তু এখানে শুধুমাত্র একটি ছবির ওপর ভিত্তি করে বর্তমান চেহারা বের করার চেষ্টা করা হয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল টিবেট নেটওয়ার্কের জন্য চারবছর আগে এই ছবিটি তৈরি করা হয়। পাঞ্চেন লামার নিখোঁজ হওয়ার বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এটি তৈরি করা হয়েছিল, যখন তার বয়স হওয়ার কথা ২৬ বছর।

ওই ছবিতে তাকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো একটি চাদর পরে থাকতে দেখা যায়, যদিও তিনি এরকম ধর্মচর্চা করার সুযোগ পান কিনা, তার সপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।

পাঞ্চেন লামা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?

দালাই লামার মতো পাঞ্চেন লামাকেও বুদ্ধের একজন অবতার বলে মনে করা হয়। তাকে বলা হয় বুদ্ধের সীমাহীন আলোকবর্তিকা, যেখানে দালাই লামা হচ্ছেন বুদ্ধের দয়ার অবতার।

ঐতিহ্যগতভাবে তারা একজন অপরজনের পরামর্শক হিসাবে কাজ করেন এবং অপরজনের পুনর্জন্মকারীকে খুঁজে বের করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

দালাই লামার চেয়ে যেহেতু পাঞ্চেন লামার বয়স ৫০ বছর কম, তাই ধারণা করা হয় তিনি একসময় ৮৩ বছর বয়সী দালাই লামার স্থলাভিষিক্ত হবেন।

১৯৯৫ সালে যখন চীন পাঞ্চেন লামার বাছাই প্রক্রিয়ার অংশ হতে চায়, তখন থেকেই হয়তো সেই মুহূর্তের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।

অবসর ও পুনর্জন্ম নামের একটি বার্তায় ২০১১ সালে দালাই লামা লিখেছেন, ” তারা বলছে, তারা আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে এবং ১৫তম দালাই লামাকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী বাছাই করে নেবে।”

পাঞ্চেন লামাকে ছাড়া কি আরেকজন দালাই লামা সম্ভব?

যদিও দালাই লামার পুনর্জন্মকারীকে খুঁজে বের করতে গুরুত্বপূর্ণ পালন করবেন পাঞ্চেন লামা, কিন্তু এই কার্যক্রমে তিনি একাই সব নন বলে বলছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর টিবেটের ভাইস-প্রেসিডেন্ট বৌচুং সেরিং।

তবে তিনি ধারণা করেন, যখন সেই সময় আসবে, তখন চীনা কর্তৃপক্ষ ‘হয়তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য তাদের পছন্দের কোন ব্যক্তিকে পাঞ্চেন লামা হিসাবে বাছাই করবে’।’

এ বছর মার্চে রয়টার্সকে দালাই লামা বলেছেন, তার উত্তরসূরিকে ভারতে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, যেখানে তিনি এবং অন্য অনেক তিব্বতি প্রায় ৬০ বছর ধরে বাস করছেন।

তিনি আরো বলেছেন, এ বছরের শেষের দিকে তিব্বতের বুদ্ধদের সঙ্গে ভারতে একটি বৈঠক হবে, যেখানে আলোচনা হবে যে, আদৌ আর দালাই লামার প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে কিনা।

নতুন ছবি প্রকাশের কারণ কী?

সাধারণত কোন ব্যক্তির নিখোঁজের ঘটনায় এরকম ছবি তৈরি করা হয়, যাতে আশা করা হয় যে, কখনো কেউ তাকে দেখতে পেলে কর্তৃপক্ষকে জানাবে।

পাঞ্চেন লামা গিনডু চোকি লামার ক্ষেত্রে আরো বেশি আশা করা হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক মনোযোগের কারণে চীনের কর্তৃপক্ষ হয়তো তার সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য জানাবে।

”তিনি কি ধরণের জীবনযাপন করছেন, কি পড়ছেন, এসব সম্পর্কে কোথাও কোন তথ্য নেই। এমনকি তিনি কোথায় আছেন, তা নিয়েও পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যায়,” বলছেন ম্যান্ডি ম্যাকেউন, ইন্টারন্যাশনাল টিবেট নেটওয়ার্কের একজন সদস্য।

তার সম্পর্কে তথ্য পেলে তারা আন্তর্জাতিক যাচাইকরণ এবং তাকে তিব্বত বা প্রবাসে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে দেওয়ার জন্য দাবি করবেন।