যে সুর মৃত্যু ডেকে আনত!

সংগীত আত্মার খোরাক। সুর যেখানে প্রাণ। আর সেই সুরই যদি মৃত্যুর জন্য দায়ী হয় তা হলে বিষয়টি মনোরঞ্জনের না হয়ে হয় আতঙ্কের।

আঠারো শতকের শেষের দিকে এমনই অভিযোগ এসেছিল এক বাদ্যযন্ত্রের ওপর। যার নাম- গ্লাস হারমোনিকা। বাদ্যযন্ত্রটির ওপর এ অভিযোগ এনেছিলেন খোদ এর বাদক ও শ্রোতারা।

এ যন্ত্রটির উদ্ভাবক আমেরিকার ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। যিনি দেশ পরিচালনার পাশাপাশি যন্ত্রসংগীতে মেতে থাকতেন।

একবার লন্ডনের এক অনুষ্ঠানে এক সংগীতজ্ঞের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। সেদিন সেই সংগীতজ্ঞ ওয়াইন ভর্তি থরে থরে সাজানো কাঁচের পেয়ালায় হাত ছুঁয়েছিলেন। অমনি গোটা হল মেতে উঠত চমৎকার সব সুরে।

এ অনুষ্ঠানের পরপরই সুরপাগল যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বিষয়টিকে যন্ত্রে রূপ দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করলেন।

যা ভাবা তাই কাজ। ১৭৬১ সালে সুরের এই মেকানিক্যাল ভার্সন তৈরি করেন ফ্রাঙ্কলিন। কতগুলো রডের ওপর বিভিন্ন জ্যামিতিক কোণে তিনি সাজালেন ৩৭টি ঘুরন্ত কাচের পেয়ালা। এতে স্পর্শ করলেই বেজে উঠত মন মাতানো শব্দঝঙ্কার।

তিনি এ বাদ্যযন্ত্রের নাম দিলেন গ্লাস আরমোনিকা বা গ্লাস হারমোনিকা। এ হারমোনিকার সুরে মেতে ওঠে পুরো বিশ্ব।

কিন্তু এর পরের ইতিহাস ভয়াবহ।

খুব জনপ্রিয় হতে থাকে গ্লাস হারমোনিকা। কিন্তু যারা এই বাদ্যযন্ত্রের নিত্য শ্রোতা, তাদের মধ্যে নানা অসুখ দেখা দিতে থাকে।

স্নায়ুবিক জটিলতায় ভুগতে থাকেন অনেকে। অনেকের চোখ, মাথার অসহ্য যন্ত্রণা হতে থাকে।

একসময় এদের কেউ কেউ এসব যন্ত্রণা নিয়ে মারা যেতে থাকেন।

গ্লাস হারমোনিকার শ্রোতারা ও এর বাদকগণ এই যন্ত্রকে এসব রোগের কারণ হিসেবে অভিযোগ তুলতে শুরু করেন।

এভাবেই চলতে থাকে দুই যুগ। ১৭৯৯ সালে অ্যান্টনি উইলিচ নামে এক চিকিৎসক, এই বাদ্যযন্ত্র নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।

তিনি দাবি করেন, মস্তিষ্কের বিশেষ অংশকে অতি সক্রিয় করে তোলে গ্লাস হারমোনিকার সুর।

এ যন্ত্রের সুর বেশি কানে গেলে ঘুমভাব, হ্যালুসিনেশন, প্যারালাইসিস- এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে বলে দাবি করেন এ স্নায়ু বিশেষজ্ঞ।

এর পর বেশ কিছু মনোবিজ্ঞানী দাবি করেন, আত্মহত্যার মানসিকতা জাগিয়ে তোলে এই বাদ্যযন্ত্র।

পরবর্তী শতাব্দীর শুরুতেই গ্লাস হারমোনিকার ওপর আসে আরেকটি কুঠারাঘাত। ১৮০৮ সালে ভিয়েনায় একটা কনসার্টে গ্লাস হারমোনিকায় নিজের তৈরি সুর বাজাতে গিয়ে মঞ্চেই মৃত্যু হয় মারিয়ানা কির্চজেসনার নামে এক জন্মান্ধ সংগীতজ্ঞের।

এ ঘটনার পর সমালোচনায় ফেটে পড়ে চারদিক।

মারিয়ানার মৃত্যুর জন্য ফ্রাঙ্কলিনের গ্লাস হারমোনিকাকে দায়ী করতে শুরু করেন অনেকে।

প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে জনপ্রিয় থাকা এ বাদ্যযন্ত্রটির ব্যবহার একেবারে কমে যেতে শুরু করে।

জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও কয়েকটি গ্লাস হারমোনিকা রয়েছে। বিখ্যাত কয়েকজন সুরকার তাদের অ্যালবামে এই বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছণা কিছুক্ষণের জন্য যোগ করেছেন।

বর্তমানে ফিলাডেলফিয়ায় ফ্রাঙ্কলিন ইনস্টিটিউটে গেলেই দেখা মিলবে মৃত্যুর দূত নামে খ্যাত সেই ফ্রাঙ্কলিনের তৈরি প্রথম গ্লাস হারমোনিকাটি।