রমজান শেষে ডায়াবেটিক রোগীর সুস্বাস্থ্য

ডা. শাহজাদা সেলিম : মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় আচরণ হল রমজান মাসে রোজা রাখা। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৬ কোটির অধিক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মুসলমান এ রমজানে রোজা রাখছেন। ভৌগোলিক অবস্থান ও মৌসুম ভেদে এ সময়কাল কয়েক ঘণ্টা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে।

আমাদের দেশে সেহরি ও ইফতারের মধ্যবর্তী সময় সর্বোচ্চ ১৮ ঘণ্টা হতে পারে।

এ দীর্ঘ সময় একজন ডায়াবেটিক রোগীর না খেয়ে থাকা উচিত হবে কিনা তা নিয়ে অনেক বছর ধরে বহু বিতর্ক হয়েছে। অবশেষে পৃথিবীর মুসলমান ও অমুসলমান ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে মতামত দিয়েছেন যে, ডায়াবেটিক রোগীর পক্ষে রোজা রাখা ক্ষতিকর হবে।

কোরআন শরিফেও রোগাক্রান্তদের রোজা রাখা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩- ১৮৫) আর অন্য যে কোনো ধরনের অসুখের চেয়ে ডায়াবেটিস নিয়মিত ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। ডায়াবেটিক রোগীর বিপর্যস্ত বিপাকীয় তন্ত্রের কারণে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে শারীরিক নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। তারপরও কিছু কিছু ডায়াবেটিক রোগী রমজানের রোজা রাখতে জিদ করেন।

কোনো ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডায়াবেটিক রোগীকে রোজা রাখার পরামর্শ দেবেন না।

কিন্তু কোনো ডায়াবেটিক রোগী যদি ধর্মীয় প্রচণ্ড আগ্রহের কারণে রোজা রাখতে চান তবে তাকে নিষেধ করাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে আমরা ডায়াবেটিক রোগীর রোজা রাখার কারণে যেসব সমস্যা হতে পারে এবং তা থেকে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকার পদ্ধতি আলোচনা করব।

রোজা রাখার সময় ডায়াবেটিক রোগীর ঝুঁকিগুলো-

* রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া)

* রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া)

* ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস

* পানি শূন্যতা ও থ্রম্বোএম্বোলিজম

রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে থেকে যাদের ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ খুব ভালো ছিল তাদের পুরো রমজান মাস যেমন তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই পার হয়ে যাওয়ার কথা।

কিন্তু যারা টাইপ ১ ডায়াবেটিসের রোগী, যাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ আশানুরূপ নয় অথবা যাদের একই সঙ্গে কিডনি ও লিভার দীর্ঘস্থায়ী কোনো রোগে আক্রান্ত এবং যাদের কোনো ধরনের জীবাণু সংক্রমণ হয়েছে তাদের সবারই ডায়াবেটিসজনিত কোনো না কোনো জটিলতা দেখা দেয়ার কথা।

যেসব ডায়াবেটিক রোগী সব ঝুঁকির কথা জেনেও রোজা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের রোজা শুরুর কমপক্ষে ১ মাস আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। এর মধ্যে আছে খালি পেটে ও খাবার ২ ঘণ্টা পর (মোট ৬ বার) রক্তের গ্লুকোজ, খালি পেটে রক্তের লিপিড, লিভার, কিডনি ও হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতার পরীক্ষা এবং এইচবিএ১সি ইত্যাদি পরীক্ষা করে নিতে হবে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা হল রক্তের গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া); কিছু কিছু ক্ষেত্রে রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। দুটি ক্ষেত্রেই রোগী হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হতে পারে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র হল সুশৃঙ্খল জীবনযাপন। সুশৃঙ্খলা বলতে খাওয়া দাওয়া, শারীরিক শ্রম, অন্যান্য কর্মকাণ্ড চিত্তবিনোদন সবই বুঝায়। যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হননি তারা তো বটেই, যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে মোটামুটি সক্ষম হয়েছেন তারাও রোজাকালীন বিপাকীয় দুর্বিপাকে পড়ার আশংকা থাকে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া অতি জরুরি।

রমজান শেষে আবার রমজান পূর্ববতী স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে গিয়ে কিছু সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরামর্শ হল-

রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ জেনে নিন। প্রথমে (অভুক্ত অবস্থায়, সকালে নাস্তার ২ ঘণ্টা পরে, দুপুরে খাবার আগে ও ২ ঘণ্টা পরে ৬ বার)।

রক্তের HbA1C পরীক্ষা

কিডনি ও লিভারের পরীক্ষা

প্রস্রাব পরীক্ষা

* এসব রিপোর্ট আপনার চিকিৎসকদের দেখাবেন। তবে সাধারণভাবে খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সংযমী ও বিবেচক হওয়া অতি জরুরি।

* প্রতিদিনের ক্যালোরি গ্রহণ সীমার মধ্যে রাখতে হবে।

* প্রচুর পরিমাণে তরল খাদ্য গ্রহণ করবেন।

* ঈদের আনুষ্ঠানিকতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে প্রচুর সেমাই পায়েস খাওয়া উচিত হবে না।

* দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।

* কারও কারও পাতলা পায়খানা, বুক জ্বালা করা ও হজমে সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।

* সবাইকেই তার নিজের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসকরা এ ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করবেন।

সবাকে ঈদের শুভেচ্ছা।

লেখক : হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

Email: [email protected]