রসিক নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই ইসির

রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনকে ‘ভালো’ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এই সিটিতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। সব ধরনের প্রভাবমুক্ত থেকে ইসি জাতিকে সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে, এই নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে মেলালে চলবে না। এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু করে কমিশনের আত্মতৃপ্তিরও কিছু নেই। কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে মেলানোর সুযোগ নেই। কমিশনের উচিত, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। সব দলের অংশগ্রহণে যেন একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যায়, সে বিষয়ে এখন থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে ইসিকে। রংপুর নির্বাচন নিয়ে জানতে চাইলে শুক্রবার দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।

প্রসঙ্গত, কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির অধীনে বুধবার রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিপুল ভোটে মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমান কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বড় ধরনের কোনও গোলযোগ বা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি নির্বাচনে প্রশাসনের কোনও প্রভাব বিস্তারের খবরও। নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্টি প্রকাশ করে এই নির্বাচনকে ‘মডেল‘ নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিষয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনটা নিঃসন্দেহে ভালো হয়েছে। দেশবাসী এ ধরনের নির্বাচনই দেখতে চায়। নির্বাচন কমিশন তার সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। কমিশন এটাকে মডেল নির্বাচন করার কথা বলেছিল। এক অর্থে তারা সেটা করতে সক্ষম হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোও দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। সরকারও নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেনি।’

এক প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এই নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচননের মেলালে চলবে না। কারণ, তারা এই নির্বাচনে যে পরিমাণ লোকবল ও রিসোর্স নিয়োগ করেছে, নির্বাচনটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছে, জাতীয় নির্বাচনে সেটা সম্ভব হবে না।’

এ প্রসঙ্গে সুজন সম্পাদক আরও বলেন, ‘নির্বাচন ভালো হবে কি মন্দ হবে, সেটা কেবল কমিশনের ওপর বর্তায় না। রাজনৈতিক দলের সদাচরণ, সরকার তথা প্রশাসনের নিরপেক্ষতার ওপরও এটা নির্ভর করে। নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর ইসির পক্ষেও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়।’

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তারেক সামসুর রেহমানও একই ধরনের মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও সুন্দর হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই নির্বাচনের জন্য কমিশনকে ধন্যবাদ দিতে চাই। কিন্তু এই নির্বাচন দিয়ে কোনও অবস্থাতেই জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়ার সুযোগ নেই।’

এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘বর্তমান ইসির সময়ে অনুষ্ঠিত রংপুর ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন—দুটোতেই ইসি সফলতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু এই সফলতা দিয়ে তারা আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে ভুল করবে। কমিশনের মূল কাজ হবে জাতীয় নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা। সব দলের অংশগ্রহণে যেন ওই নির্বাচনটি হয়, সেই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন, ‘এটি একটি উত্তম নির্বাচন হয়েছে। তবে, এটি ভালো হয়েছে, তার মানে এই নয় যে, সব নির্বাচন ভালো করা সম্ভব। আমাদের সময়ও তো এই রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ভালো হয়েছিল। এই নির্বাচন ভালো হয়েছে, আবার দেখবেন কোনও এলাকায় গোলমাল লেগে গেছে। অনেক এলাকায় নির্বাচনে মানুষ গোলমাল করে। আপনি সবাইকে কিভাবে পাহারা দেবেন?’

ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি) পরিচালক আব্দুল আলীম কোনও ধরনের গোলযোগ সহিংসতা, কারচুপি ও অনিয়ম না থাকায় রংপুর সিটি নির্বাচনকে মডেল নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর একটি মোর্চা ইডব্লিউজি পরিচালক আব্দুল আলীম বলেন, ‘সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় যে চিত্র আমরা দেখেছি, তা রংপুরে ছিল না। কোনও সংহিসতা, অনিয়ম ও কারচুপি হয়নি এই ভোটে।’

এই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনি প্রক্রিয়ার প্রতি অংশীজনের আস্থা বাড়াবে মন্তব্য করে আব্দুল আলীম বলেন, ‘রংপুরে একটি সমন্বিত নির্বাচন হয়েছে। সুষ্ঠু ভোটের জন্য যা যা করা দরকার, তাতে সবার সহযোগিতা ছিল। এটাকে মডেল নির্বাচনও বলা যায়। এ রকম নির্বাচনই মানুষ প্রত্যাশা করে।’

অন্য বিশ্লেষকদের মত আব্দুল আলীমও মনে করেন রংপুর সিটি নির্বাচনের ফল নিয়ে সংসদ নির্বাচন বিশ্লেষণের কোনও সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে স্থানীয় ভোটারদের একটি ফ্যাক্ট কাজ করে। প্রার্থীর সঙ্গে নিজ এলাকার ভোটারদের একটি সম্পর্ক রয়েছে। এটা নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আবহে বর্ণনা করার কোনও সুযোগ নেই।’-প্রতিবেদন বাংলা ট্রিবিউনের সৌজন্যে প্রকাশিত।