রাখাইনে তীব্র খাদ্য সংকট : বাংলাদেশের পথে লাখো রোহিঙ্গা

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। রাখাইনে বাড়ি, ফসল ও দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়ায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য সংকটও। আশঙ্কা করা হচ্ছ, বাংলাদেশে আরও রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসবেন। জাতিসংঘের মতে, আগামী ছয় মাসে আরও তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ পালিয়ে আসতে পারে।

সদ্য বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, প্রতিদিন কোনও না কোনও এলাকায় পড়ে থাকা খালি বসত বাড়িগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন দোকানপাট ও বাজারগুলোতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে মজুদ থাকা চালের গুদাম ও দোকান। গ্রামের নলকূপ থেকে শুরু করে পুকুরের পানিও নষ্ট করে দিচ্ছে মিয়ামারের সেনাসদস্যরা। এতে করে তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েছেন আত্মগোপনে থাকা রোহিঙ্গারা।

দু’দিন আগে উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কিয়াংমং এলাকার বাসিন্দা আবু তাহের ও তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম। তারা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রাণ বাজি রেখে রাখাইনেই লুকিয়েছিলেন তারা। কিন্তু, খাওয়ার মতো কিছু ছিল না। বিশুদ্ধ পানি থেকে শুরু করে কোনও ধরনের খাদ্য সামগ্রী নেই রাখাইনে।

রাখাইনের শীলখালী গ্রামের আবুল কালাম জানান, যারা পাহাড়ের কিনারায় বসবাস করছিলেন, তারা এতদিন বাংলাদেশে না এসে পালিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। কিন্তু, এখন আর সেখানে থাকার কোনও সুযোগ নেই। খালি পড়ে থাকা বসতবাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাটবাজার ও চালের গুদামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে সেনাবাহিনী। ধ্বংস করছে কোটি টাকার সম্পদ।

শুক্রবার (৬ অক্টোবর) জুমার দিনে রাখাইনের বিভিন্ন এলাকায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখা গেছে। ওইদিন রাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে মংডুর উত্তরে ডাংগার ডেইল বাজারে। এতে কোটি কোটি টাকার পণ্য আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। একইভাবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়া, তুমব্রু, কুমিরখালী, শীলখাল, কিয়াংমং, বলিবাজার, বুচিডং, নাফপুরাসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে টেকনাফের লেদা, উনচিপ্রাং, উখিয়ার বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু।

জাতিসংঘের মতে, এখনও রাখাইনে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। এতে করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর সেই বিপন্ন মানুষদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জেনেছে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি। জাতিসংঘের আশঙ্কা, রাখাইনে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশে চলে আসবে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ৯ লাখ ছাড়িয়েছে। রাখাইনে অবশিষ্ট তিন লাখ রোহিঙ্গাও যদি চলে আসে, তাহলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১২ লাখে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে তারা।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫ লাখ ৯ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। সংস্থাটির আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াকিনস বলেন, ‘কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গারা খুবই নাজুক অবস্থায় আছে। তাদের অনেকেই এখন সেই বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাদের বসবাসও করতে হচ্ছে অনেক মানবেতর পরিস্থিতিতে। আমাদের লক্ষ্য ১২ লাখ রোহিঙ্গার মানবিক সহায়তা নিশ্চিতের জন্য প্রস্তুত থাকা। কারণ, ইতোমধ্যে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বাংলাদেশে। আর আগামী ছয় মাসে আরও তিন লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে প্রবেশের সম্ভাবনা রয়েছে।’

ক্যাম্পে রোহিঙ্গা শিশুরা সারিবদ্ধ হয়ে এভাবেই দুবেলা খাবার সংগ্রহ করছেবাংলাদেশ ও ত্রাণ সংস্থাগুলো এই বিশাল সংখ্যার রোহিঙ্গাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এরইমধ্যে সহায়তায় এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘ, ইউনিসেফসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। রোহিঙ্গাদের ওপর এই নির্যাতনকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ। তবে মিয়ানমার বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তাদের দাবি, বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে তারা। গত বছর অক্টোবরেও পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছিল রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের সশস্ত্র এই বিদ্রোহী সংগঠনটি। সেই সময়েও ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

উল্লেখ্য, গত (৩ অক্টোবর) সোমবার বেলা ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর দফতরের মন্ত্রী উ টিন্ট সোয়ে। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে মিয়ানমার।’ একই সঙ্গে দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এ কারণে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে একটি চুক্তির খসড়া দিয়েছে বাংলাদেশ।