রাঘব বোয়াল চেয়ে চুনোপুঁটি পেল দুদক

রাজশাহী অঞ্চলের মাদক সম্রাটদের তালিকা পাচ্ছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে এ অঞ্চলের যে ২২ মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা পেয়েছে প্রাথমিক তদন্তে নেমে তাদের কাছ থেকে তেমন কিছুই পায়নি দুদক। এতে মাদক ব্যবসায়ীদের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ খুঁজে বের করতে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাটি।

দুদকের দাবি, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছে তালিকা চেয়ে সাড়া পাননি তদন্তকারী কর্মকর্তারা। ফলে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে ভিড়তেই পারেনি দুদক।

রাজশাহী দুদক জানিয়েছে, এ অঞ্চলের মাদক ব্যবসায়ীদের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি অনুসন্ধানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছ থেকে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা চেয়েছিল দুদক। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই প্রথম দফা তালিকা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। সাড়া না পেয়ে ওই বছরেরই ৭ ডিসেম্বর আরেক দফা চিঠি পাঠানো হয়।

এরই প্রেক্ষিতে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর দুদক মহাপরিচালক বরাবর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ২২ জনের একটি তালিকা দেয়। এ বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ওই তালিকা দুদকের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ে আসে।

গত ৯ মে থেকে তালিকা ধরে তদন্ত শুরু করে দুদক। ওই তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এক নম্বরেই রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের মহানজনপাড়া (ফকিরপাড়ার) এলাকার মৃত সতেমান ফকিরের ছেলে কবির ফকির। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের চুনাখালী গুমপাড়া এলাকার সোহবান আলীর ছেলে কামাল ডিলার রয়েছেন তালিকায় দুই নম্বরে। তিন নম্বরে রয়েছেন পার্শ্ববর্তী চুনাখালী বাগাইড়পাড়ার ইসরাইল বাগাইড়ের ছেলে দুলাল ওরফে দুরু।

মাদকের প্রবেশদ্বার খ্যাত রাজশাহীর গোদাগাড়ী। এখানে অন্তত কয়কশ বড় মাপের মাদক ব্যবসায়ীর বাস। এরা রাতারাতি শূন্য থেকে কোটিপতি বনে গেছেন। অথচ দুদকের হাতে রয়েছে এখানকার মাত্র ৬ মাদক ব্যবসায়ীর নাম।

ওই তালিকার ৪ থেকে ৮ এবং ১০ নম্বরে থাকা এসব মাদক ব্যবসায়ী হলেন, গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জের ইসরাইল হোসেনের ছেলে কালু মিয়া, একই উপজেলার মাজারগেট মেলাপাড়ার সুরুত মিয়ার ছেলে সাইফুল ইসলাম ও মৃত গণি মিয়ার ছেলে কুদ্দুস মিয়া, একই উপজেলার মাটিকাটা ২ নম্বর রেলগেট এলাকার আনোয়ারুল ইসলামের ছেলে তারেক মিয়া, একই উপজেলার মাদারপুরের খোরশেদ আলমের ছেলে তোহিদুল ইসলাম এবং উপজেলার আচুয়া সিঅ্যান্ডবি গ্রামের মৃত ইসরাফিলের ছেলে বাবু মিয়া।

এছাড়া তালিকায় ৯ নম্বরে রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার শেখেরচক এলাকার জিল্লুর রহমানের ছেলে ডলার, ১১ নম্বরে চারঘাট উপজেলার হলিদাগাছি স্কুলপাড়া গ্রামের মৃত গোলাম পাঞ্চাতন ওরফে আকালুর ছেলে আশরাফ মেম্বার, ১২ নম্বরে বাঘা উপজেলার হেলালপুর গ্রামের মৃত আকাশেদ মোল্লার ছেলে ইদ্রিস মোল্লা এবং ১৩ নম্বরে একই গ্রামের মৃত রহমানের ছেলে দোয়েল রয়েছেন।

২২ জনের ওই তালিকায় রয়েছেন ১৪ নম্বরে দিনাজপুরের কোতয়ালি উপজেলার সরসতীপুর গ্রামের ফারিজুল ইসলামের ছেলে জাবেদ আলী ও ১৫ নম্বরে জেলার হাকিমপুর উপজেলার মধ্যবাসুদেবপুর মাঠপাড়া গ্রামের মৃত ফটিক প্রামানিকের ছেলে রুহুল প্রামানিক, ১৬ নম্বরে বগুড়ার সদর থানার বেলাই তিন মাথা গ্রামের রইস উদ্দিনের ছেলে সবুজ শেখ, ১৭ নম্বরে বগুড়ার কাহালু থানার ডোমার গ্রামের আনোয়ার হোসেনের ছেলে সাদ্দাম হোসেন রাজু, ১৮ নম্বরে নওগাঁর পত্নীতলা থানার কেশবপুর গ্রামের মৃত ইসমাইল হোসেনের ছেলে রেজাউল হক, ১৯ নম্বরে সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর উপজেলার চুড়িখালীপাড়া গ্রামের মৃত কাশেম আলমের ছেলে শফিকুল ইসলাম, ২০ নম্বরে নিলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার পশ্চিম বাবু পাড়া গ্রামের মৃত ফুল মোহাম্মদের ছেলে শাকিল ওরফে বরকা, ২১ নম্বরে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ইসলামপুর নোয়াখালী পাড়া এলাকার মৃত ভোলার ছেলে মজনু এবং ২২ নম্বরে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার গোবর্দ্ধনকুটি গ্রামের শাহাজান আলী তালুকদারের ছেলে শহিদুল ইসলাম শাহিন।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করে দুদকের রাজশাহী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তালিকা পাওয়ার পর তারা অনুসন্ধানে নেমেছেন। প্রাথমিকভাবে তারা জানতে পারেছেন, তালিকাভুক্তরা ছোটখোট মাদক ব্যবসায়ী। কেউ কেউ মাদক বহনে জড়িত থাকার দায়ে অভিযুক্ত। তবে তাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য মেলেনি।

দুদকের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, তদন্তে নেমে জেলা পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছিল দুদক। কিন্তু সাড়া মেলেনি। ফলে তদন্ত চলছে ধীর গতিতে।

অপরদিকে দুদক এমন তথ্য তাদের কাছে চায়নি বলে দাবি করেছেন রাজশাহী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপপরিচালক লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে দুদক মহাপরিচালক বরাবর এমন একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। বিষয়টি তিনি জানেন। কিন্তু ওই তালিকা কিভাবে তৈরি করা হয়েছে সেটি জানেন না। তাদের তালিকায় এলাকায় এমন অনেক মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (সদর) আবদুর রাজ্জাক খান বলেন, দুদকের পক্ষ থেকে এমন তথ্য চাওয়ার খবর তাদের কাছেও নেই। তাছাড়া পুলিশের কাছেও মাদক ব্যবসায়ীদের আলাদা তালিকা রয়েছে।

এ বিষয়ে দুদকের রাজশাহীর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুল করিম বলেন, তারা ওই তালিকা নিয়ে কাজ করছেন। প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসছে তালিকাভুক্তদের অধিকাংশই ছোটখাটো মাদক ব্যবসায়ী। তারা যেটুকু তথ্য পেয়েছেন তদন্ত করছেন। তবে আইনি সীমাবদ্ধতা থাকায় তারা বেশি গভীরে যেতে পারছেন না। এ নিয়ে স্থানীয় পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগও করেন তিনি।