রাজধানীজুড়ে কালো কাচের হাইয়েস মাইক্রোবাস আতঙ্ক!

কালো কাচের হাইয়েস মাইক্রোবাস রাজধানীতে এখন এক ভয়াবহ আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দিনের আলোয় প্রকাশ্যে অপহরণের মতো ঘটনা ঘটছে রাজধানীর রাজপথে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে সাদা বা কালো রঙের হাইয়েস মাইক্রোবাস।

আর অপহরণকাণ্ডে সময় অপহরণকারীরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে। র্যাব বা ডিবি পুলিশের পরিচয়ে ২২ আগস্ট থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ছয় দিনে রাজধানীর বিভিন্ন রাজপথ থেকে তাবলিগে আসা তিনজন, দুই ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ, শিক্ষার্থী ও ব্যাংক কর্মকর্তাসহ মোট ৮ জন অপহৃত হয়েছেন।

নিখোঁজ ৮ জনের মধ্যে ৬ জনের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তাদের স্বজনকে কালো কাচে আবৃত সাদা বা কালো রঙের হাইয়েস মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়েছে।

উপরন্তু আরও উদ্বেগের বিষয়, অপহৃতদের স্বজনরা তেমন কোনো আইনি সহায়তা পাচ্ছেন না; মিলছে না অপহৃতদের সন্ধানও। অপহৃতদের উদ্বেগাকুল স্বজনরা আইনের দ্বারস্থ হচ্ছেন বলতে স্রেফ সংশ্লিষ্ট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করছেন উপায়ান্তর না পেয়ে। এর পর প্রতিদিনই তারা প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন নিখোঁজ প্রিয়জনের সন্ধানে।

সাত দিনে নিখোঁজ আটজনের মধ্যে তিনজনকে চোখ-হাত বাঁধা অবস্থায় মতিঝিলের রাস্তায় ফেলে গেছে অপহরণকারীরা। আর অন্য পাঁচজনের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তারা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা- এসব প্রশ্ন যারপরনাই ভাবিয়ে তুলছে স্বজনদের।

এদিকে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাইভেটকারে কালো গ্লাস ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও মাইক্রোবাসে নেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কেন এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না- এমন প্রশ্নও উঠছে সঙ্গত কারণেই।

২২ থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত অপহৃতরা হচ্ছেন হাফেজ মাওলানা আবদুল্লাহ আল মামুন, মো. আ. রহমান (শিক্ষার্থী), মো. ইউসুফ (শিক্ষার্থী), ইশরাক আহমেদ ফাহিম (শিক্ষার্থী), অনিরুদ্ধ রায় (ব্যবসায়ী), সাদাত আহমেদ (বিএনপি নেতা), শামীম আহমেদ (ব্যাংক কর্মকর্তা) এবং এমএম আমিনুর রহমান (কল্যাণ পার্টির মহাসচিব)।

তাদের মধ্যে আ. রহমান, মো. ইউসুফ ও শামীম আহমেদকে অপহরণ করে পরবর্তী সময়ে চোখ-হাত বাঁধা অবস্থায় রাজধানীর রাজপথে ফেলে যায় অপহরণকারীরা।

এদিকে এসব অপহরণকান্ডের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও তেমন কোনো তথ্য নেই; মিলছে না তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য। কারা এসব কা- ঘটাচ্ছে তা-ও উদ্ঘাটনে ব্যর্থ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
রাজধানী থেকে দিনের আলোয় একের পর এহেন অপহরণকান্ডে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভেতর দিন দিন বাড়ছে আতঙ্ক। অনেকেই ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়।

অন্যদিকে অপহরণের পর চোখ-হাত বাঁধা অবস্থায় যাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে রাজপথে, তারাও মুখ খুলছেন না। এমনকি অপহৃতদের পরিবারও অজানা আশঙ্কায় কোনো কথা বলতে নারাজ।

২৬ আগস্ট বিকালে কাকরাইল মসজিদের গেটের ভেতর থেকে প্রকাশ্যে অপহরণ করা হয় হাফেজ মাওলানা আবদুল্লাহ আল মামুন এবং আবদুর রহমান ও ইউসুফ নামে দুই শিক্ষার্থীকে। তারা তাবলিগ জামায়াতের চিল্লায় এসেছিলেন কাকরাইল মসজিদে। র্যাব ১০-এর সদস্য পরিচয়ে কালো কাচের কালোরঙা হাইয়েস মাইক্রোবাসে করে ওই তিনজনকে ৮ থেকে ৯ দুর্বৃত্ত তুলে নিয়ে যায় বলে ২৭ আগস্ট রাজধানীর রমনা থানায় একটি জিডি করেন মাওলানা আবদুল্লাহর বোনের স্বামী সাইফুল ইসলাম। তিনি জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার।

সেদিন বিকালে কালো গ্লাসের একটি হাইয়েস মাইক্রোবাসে ওই ৩ জনকে টেনেহিঁচড়ে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাত-চোখ বেঁধে ফেলা হয়। ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট চলে তাদের গাড়ি। এর পর ওই অবস্থায়ই তাদের একটি ভবনের বারান্দায় নিয়ে বসানো হয়। পেটানো হয় বেধড়ক। নানা প্রশ্নবানে জরজরিত করার একপর্যায়ে আর কখনো কাকরাইল এলাকায় দেখা গেলে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রাত ৯টার দিকে হাত-চোখ বাঁধা অবস্থায়ই আ. রহমান ও ইউসুফকে মতিঝিলের আরামবাগ এলাকার একটি রাস্তায় ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। ওই দুজনেরও এখন খোঁজ মিলছে না বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।

রমনা থানার ওসি মশিউর রহমান বলেন, গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি তদন্ত চলছে। নিখোঁজ আবদুল্লাহ আল মামুনকে উদ্ধারে জোর চেষ্টায় আছি আমরা।

এদিকে আবদুল্লাহ আল মামুন যেদিন অপহরণের শিকার হন সেদিনই (২৬ আগস্ট) ধানমন্ডির শঙ্কর এলাকার খুশবু রেস্টুরেন্ট থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে অপহৃত হন কানাডার মন্ট্রিলের স্বনামধন্য ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্র ইশরাক আহমেদ ফাহিম।

পরদিন রাজধানীর ৭২ গুলশান অ্যাভিনিউ ইউনিয়ন ব্যাংকের সামনে থেকে তুলে নেওয়া হয় ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়কে। ২২ আগস্ট তুলে নেওয়া বিএনপি নেতা ও ব্যবসায়ী সাদাত আহমেদের কোনো খোঁজ মেলেনি আজও। ২৩ আগস্ট পল্টন থেকে অপহৃত ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম আহমেদের মুক্তি মিললেও ঘটনার কোনো রহস্যই উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

অপহরণের পাঁচ দিন পর একটি মাইক্রোবাসে করে শামীমকে মতিঝিল এলাকায় রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। তিনিও ঘটনার বিষয়ে মুখ খুলছেন না। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এমএম আমিনুর রহমানকে অপহরণ করা হয় ২৭ আগস্ট। তার সন্ধান মেলেনি আজও। আমিনুর রহমানের বড় ভাই মিজানুর রহমান জানান, কারা আমিনুরকে তুলে নিয়ে গেছে, তা ধারণা করতে পারছি না।

২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গাড়িতে কালো গ্লাস নিষিদ্ধ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এর পর কালো ও অস্বচ্ছ কাচের গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে পুলিশ। একই সঙ্গে কালো গ্লাসের গাড়ি পাওয়া গেলে জরিমানাও আদায় করা হয়। সে বছর ১৪ মে গাড়িতে কালো গ্লাস নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেওয়া সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়।

হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ এ রিট দায়ের করেন। ওই বছরের ২১ মে মাইক্রোবাস ছাড়া অন্য গাড়িতে কালো গ্লাস নিষিদ্ধ করে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কালো গ্লাস ব্যবহার করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা বিআরটিএর অনুমতি নেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।

মানবাধিকার সংঘটন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনার পর পরই সরকারের পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, পরে তারা আর অগ্রসর হননি। ফলে ওইটা ওই অবস্থায়ই আছে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রাইভেটকারে কালো গ্লাস ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও মাইক্রোবাসে নেই বলেও জানান তিনি।