রামু ট্রাজেটির ৬ বছর: সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে বিচার

কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধবিহার এবং বসতিতে দুর্বৃত্তের হামলার ঘটনার ৬ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ শনিবার।

এ সময়ের মধ্যে ফিরেছে সম্প্রীতি, মুছে গেছে ক্ষত, কিন্তু সাক্ষীর অভাবে শেষ হয়নি মামলার বিচার কার্যক্রম।

১৯ মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ আসামির মধ্যে এই পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ৫২৬।

২০১৩ সাল পর্যন্ত অধরা ছিল ১৪ হাজার ৬৫৬ জন। কিন্তু তার পরে ধীরে ধীরে জামিনে বেরিয়ে আসে গ্রেফতারকৃতরা।

পাশাপাশি পলাতকদের মধ্যেও অনেকেই আত্মসর্ম্পণ করে জামিনে বেরিয়ে যায়। বর্তমানে এখনো পলাতকের সংখ্যায় আছে ১০৬ জন।

তবে চার্জশিট হয় সব মামলারই। কিন্তু সাক্ষীর চরম সংকটে ঝুলে আছে বর্তমানে বিচার কার্যক্রম।

সূত্র মতে, এ ঘটনার হোতাদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল গঠন করা হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিটি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিলেও ছয় বছরেও মূল মামলার চূড়ান্ত শুনানির কোনো অগ্রগতি হয়নি।

তাই এসব মামলার আইনি কার্যক্রম নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। বিচারকার্য নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও সম্প্রীতির জায়গায় এসে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল তা পুরোপুরি মিটে গেছে।

ঘটনার বিবরণ মতে, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে কুরআন অবমাননাকর ছবি ট্যাগ করাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উগ্রপন্থিরা ঝলসে দিয়েছিল কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লী।

পরে রামু থেকে ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে জেলার উখিয়া ও টেকনাফসহ চট্রগ্রামের পটিয়া পর্যন্ত।

এক শ্রেণির জঙ্গিবাদরা ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বৌদ্ধপল্লীতে এবং মন্দিরে উদ্দেশ্যমূলক হামলা চালায়।

সেই সময় পুড়ে যায় ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ২৬টি বসতঘর। পাশাপাশি আরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়।

পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর বিকালে উখিয়া ও টেকনাফে আরো চারটি বৌদ্ধবিহারে হামলা চালানো হয়। এতে পুড়ে যায় এসব বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

এ ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রামু থানায় আটটি, উখিয়ায় সাতটি, টেকনাফে দুটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুটি মামলা রেকর্ড হয়।

এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে।

কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের কোর্ট পরিদর্শক কাজী দিদারুল ইসলাম বলেন, ১৯টি মামলার মধ্যে রামু থানায় সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দুপক্ষের আপোস মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত। বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। এরমধ্যে ৫টি মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে দেয়া হয়।

অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে তিনটি মামলার অভিযোগপত্রও আদালতে দাখিল করে পিবিআই।

তিনি বলেন, ১৮টির মধ্যে বর্তমানে ১৪টি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে আছে। তবে উপযুক্ত সাক্ষী না পাওয়ায় এসব মামলার গতিও থমকে আছে। নাম-ঠিকানা ধরে পাওয়া যাচ্ছে না মামলার বেশিরভাগ সাক্ষীকে। অনেক সাক্ষী আবার আসামির পক্ষে কথা বলায় চিহ্নিত হচ্ছেন ‘বৈরি সাক্ষী’ হিসেবে।

কক্সবাজার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর পরিদর্শক কৈশানু মার্মা বলেন, রামুর উখিয়ার ঘোনা জেতবন বৌদ্ধ বিহার, লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধ বিহার ও ফতেখাঁরকুলের লালচিং, সাদাচিং ও মৈত্রী বিহার এবং চাকমারকুল ইউনিয়নের অজান্তা বৌদ্ধ বিহার এবং উখিয়ার একটি মামলা আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই’র কাছে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন, মোট ৫টি মামলা তাদের কাছে পাঠানো হলেও এর মধ্যে চারটি মামলা অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের শেষের দিকে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয়েছে।

বাকি একটি মামলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশনা ছিল আদালতের।

কিন্তু ওই সময় এ পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তা কক্সবাজার পিবিআই-এ না থাকায় তদন্ত কাজ সম্পন্ন করা যায়নি। পরবর্তীতে জবাব দিয়ে আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

তবে পিবিআই কর্মকর্তার দাবি, সাক্ষী পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে অনেককে শনাক্ত করে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আদালত চাইলে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে পারেন।

কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন বলেন, মূলত সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এসব মামলায় বেশিরভাগ সাক্ষীই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তারা ভয়ে কেউ সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। আর যে কয়জন সাক্ষ্য দিয়েছেন, তারা বলেছেন উল্টো। তাই বেশিরভাগ সাক্ষীকে ‘বৈরী ঘোষণা’ করেছেন আদালত।

তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ সাক্ষী অনুপস্থিত থাকায় বিলম্বিত হচ্ছে এসব মামলার বিচার কার্যক্রম।

এদিকে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের আহ্বায়ক রজত বড়ুয়া রিকু বলেন, ১৯টি মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে কিছুই বৌদ্ধ সম্প্রদায় জানে না। এমনকি যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন, যারা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এরা কেউই পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। এ অবস্থায় বর্তমানে ভয়ে সাক্ষীরাও সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না।

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, এই ছয় বছরে আমরা ভাঙাগড়া, উত্থান-পতন অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছি। এ ঘটনায় রামুর হাজার বছরের গর্বের ধন ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে’ যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল তা কেটে উঠছে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু বিচারের পাশাপাশি সম্প্রীতির জায়গাটাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে হবে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, মোট ১৮টি মামলা চলমান রয়েছে। এই পর্যন্ত ৫২৬ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অনেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন।

এদিকে সচেতন মহলের দাবি, বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ঘটনায় যারা আসামি হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই পলাতক রয়েছেন। পাশাপাশি ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখলে বুঝা যায় আবার হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেকেই মামলা থেকে বাদ পড়েছেন। যে কারণে সাক্ষীরা অনিহা প্রকাশ করে এবং প্রকৃত হামলাকারিদের ভয়ে আদালতে সাক্ষী দিচ্ছেন না।

তবে সেই দিনের স্থির চিত্র ধরে যদি আদালত বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করে তাহলে বাদপড়া প্রকৃত অপরাধীসহ মামলার আসামিরা শাস্তির আওতায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।