রাশিয়াও কেন মিয়ানমারের পক্ষে?

এম সাখাওয়াত হোসেন : এভাবেই আসছে মানুষআগের নিবন্ধে রাশিয়ার প্রসঙ্গ টানা হয়নি। কারণ, বঙ্গোপসাগরে চীন ও ভারতের টানাপোড়েনে রাশিয়া এখন পর্যন্ত যুক্ত নয়। মিয়ানমারকে রাশিয়ার সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি ওই দুই দেশের মতো সরাসরি ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে হয়তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু পরোক্ষ যুক্ততা রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত মহাসাগর তথা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রাশিয়ার শক্তি প্রদর্শনের বিষয়টি নেই বললেই চলে। মিয়ানমারে রাশিয়ার স্বার্থ হচ্ছে সেখানে অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা, বিশেষ করে আণবিক শক্তি রপ্তানি ও সামরিক সরঞ্জামাদি রপ্তানির মাধ্যমে। রাশিয়া ও ভারত—দুটি দেশই মিয়ানমারে চীনের প্রভাব কমিয়ে নিজেদের অবস্থান জোরদারে ব্যস্ত।

এটা সবারই জানা যে মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের একঘরে থাকার বিষয়টির অবসান ঘটে ২০১৫ সালে নির্বাচন ও সেই নির্বাচনে অং সান সু চির বিজয়ের পর। তবে সু চির দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও তাঁর কাছে পূর্ণ ক্ষমতা নেই। বলা যায়, এখনো মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা কিছু কিছু জায়গায় প্রায় একচ্ছত্র। ১৯৯০-এর পর সামরিক বাহিনীর শক্তি বেড়েছে বহুগুণ। উত্তর-পূর্ব মিয়ানমারের অঞ্চলে ‘বিদ্রোহ’ মোকাবিলায় এই শক্তি কাজে লাগানো হচ্ছে। অং সান সু চির চেষ্টায় ১৪টি বিদ্রোহী বাহিনী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও আটটি শক্তিশালী বাহিনী এখনো যুদ্ধ করে যাচ্ছে। স্বাধীনতা বা অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এই যুদ্ধ চলছে। জানা যায়, চীনের প্রভাবে বর্তমান যুদ্ধবিরতিগুলো সম্ভব হয়েছে। কারণ, এসব বিদ্রোহী মূলত চীনের সমর্থন নিয়েই মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে আসছিল।

চীন গত প্রায় পাঁচ দশক এককভাবে মিয়ানমারকে সব ধরনের সহযোগিতা করলেও প্রয়োজনে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে বিদ্রোহীদের সহায়তা দিয়ে আসছিল। বর্তমানেও সেই একই অবস্থা বজায় রয়েছে। মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে সামরিক বাহিনীসহ দেশটির অর্থনীতি কার্যত চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে একুশ শতকের শুরু থেকে চীনের প্রভাব কমতে শুরু করে। মিয়ানমারের ব্যাপারে চীনের যে দ্বিমুখী নীতি, তা মেনে নেওয়া ছাড়া একসময় মিয়ানমারের আর কোনো পথ ছিল না। সেই অবস্থার অবসান ঘটে মিয়ানমার উন্মুক্ত হওয়ার পর। ২০১৫ সালের পর থেকে মিয়ানমার চীনের প্রভাব কমাতে বেশ সতর্কভাবে এগোচ্ছে। চীনের প্রভাব কমার কারণেই পূর্ব বঙ্গোপসাগরে ভারত তার অবস্থান শক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছে। পূর্ব-পশ্চিম থেকে চীন ভারতকে ঘিরে ফেলতে পারে, এই ভয়ে ভারত ভীত। পূর্বে রাখাইনে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর এবং গ্যাস ও জ্বালানি তেলের টার্মিনাল তৈরি করেছে, আবার ঠিক একইভাবে পশ্চিমে পাকিস্তানের বন্দর কাসেম থেকে গ্যাস ও জ্বালানি করিডর চীনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তৈরি হচ্ছে রেলওয়ে লাইন। তবে রাখাইন থেকে চীন পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন বিছানো প্রাথমিক পরিকল্পনায় থাকলেও আপাতত স্থগিত রয়েছে পরিবেশবাদী ও স্থানীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের আন্দোলনের কারণে।

চীন-মিয়ানমার আগের সম্পর্কে কিছুটা ফাটল ধরলেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ওপর চীনের যেমন প্রভাব রয়েছে, তেমনি চীনের অস্ত্র ব্যবহার করে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বলা হয়, এখনো কাচিন বিদ্রোহী, টাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, সান স্টেট আর্মি ও ওয়াহ টেস্ট আর্মিকে চীন সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে। এই সংগঠনগুলো তাদের জায়গায় নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করেছে। অতি সম্প্রতি এশিয়া টাইমস পত্রিকায় বার্টিন লিন্টার তাঁর এক নিবন্ধে চীন-মিয়ানমারের সম্পর্কের ফাটলের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি উদাহরণ টেনে এ বছরের এপ্রিল মাসে সান প্রদেশের কোকাং অঞ্চলে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানে মিয়ানমারের বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরেছেন। ওই যুদ্ধে ৩২ জন সামরিক কর্মকর্তা ও ৪১২ জন সৈনিক মৃত্যুবরণ করেন। এ ছাড়া চীনের সীমান্তসংলগ্ন ওই অঞ্চলে ২০১৫ সালের শুরুর দিকে কয়েক মাসের সংঘর্ষে মিয়ানমার বাহিনীর ৬৬ লাইট ইনফেন্ট্রি ডিভিশন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কাচিন রাজ্য বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানে সেনাবাহিনীকে বিমান হামলা করতে হয়েছে। হামলায় প্রথমবারের মতো রাশিয়ার অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান মিগ ২৯ ও এমআই ৩৫ গানশিপ ব্যবহার করা হয়।

বর্তমানে বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে চলমান যুদ্ধে সেনাশক্তির বদলে বিমানশক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। যে কারণে মিয়ানমারের বিমানবাহিনীকে রাশিয়ার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। বর্তমানে চীনের ওপর মিয়ানমার খুব একটা ভরসা রাখতে পারছে না, বিশেষ করে কারেন, কাচিন ও সান অঞ্চলের বিদ্রোহীদের প্রতি চীনের পরোক্ষ প্রভাবের কারণে। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের অভিন্ন সীমান্তদৈর্ঘ্য ২ হাজার ১৯২ কিলোমিটার। বর্তমানে যে দুটি অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হচ্ছে, সেই কাচিন ও সান রাজ্যের অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে চীনের সঙ্গে। এই রাজ্য দুটিতে একাধিক বিদ্রোহী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের মুক্তাঞ্চল রয়েছে। সান রাজ্যে রয়েছে ইউনাইটেড ওয়াহ স্টেট আর্মি এবং তাদের দখলে রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা। ‘পাঙ্গসাং’ নামক চীন-মিয়ানমার (সান রাজ্য) সীমান্ত শহরটি ওই অঞ্চলের অঘোষিত রাজধানী হিসেবে পরিচিত (সূত্র: বার্টিন লিন্টার: গ্রেট গেম ইস্ট ইন্ডিয়া, চায়না অ্যান্ড দ্য স্ট্রাগল ফর এশিয়াস মোস্ট ভোলাটাইল ফ্রন্টিয়ার)। এই ইউনাইটেড ওয়াহ স্টেট আর্মি শুধু ক্ষুদ্র অস্ত্রে সজ্জিত নয়, তাদের রয়েছে আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ারসহ অন্যান্য ভারী অস্ত্র এবং একাধিক গোলন্দাজ বাহিনী।

এমন পরিস্থিতিতেও মিয়ানমার চীনের বলয়ের বাইরে যেতে পারছে না। খুব শিগগির পারবে বলেও মনে হয় না। তবে সামরিক বাহিনীতে চীনের প্রভাব কমাতে মিয়ানমার সামরিক সরঞ্জামের জন্য বিভিন্ন দেশের দ্বারস্থ হতে শুরু করেছে, যার মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে রাশিয়া। হেলিকপ্টার, গানশিপ ও মিগ-২৯ কেনার কথা আগেই বলেছি। আরও বেশ কিছু মিগ-২৯ জঙ্গি বিমান কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। বিমানবাহিনীর সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে রাশিয়া মিয়ানমারের বাণিজ্যিক শহর ইয়াঙ্গুনে ‘মিগ’ কোম্পানির অফিস খুলেছে। মিয়ানমারের ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে রাশিয়া ভূমিকা পালন করছে। ১৯৯৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত রাশিয়ায় ৪ হাজার ৭০৫ জন ছাত্র উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন। এই ছাত্রদের মধ্যে ৭০০ ছাত্র পারমাণবিক বিদ্যায় পড়াশোনা করেছেন।

বর্তমানে রাশিয়া শুধু অস্ত্রের সরবরাহ করছে না, অন্যান্য ক্ষেত্রেও এবং বিশেষভাবে অর্থনৈতিক সহায়তা ও প্রযুক্তি রপ্তানির ক্ষেত্র তৈরি করছে। ২০১৩ সালে পারমাণবিক চুল্লি তৈরির ব্যাপারে রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর আওতায় দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির চুক্তি হয়ে গেছে। রাশিয়ার নজর রয়েছে মিয়ানমারের তেল ও গ্যাসক্ষেত্রগুলোর দিকে। রাশিয়ার সরকারি কোম্পানি ‘গ্যাজপ্রম’ অফিস খুলেছে ইয়াঙ্গুনে। গত মে মাসে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হিতিন কেইও রাশিয়ায় দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে জ্বালানি তেল ও গ্যাস উত্তোলনে রাশিয়ার বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের আলোচনা করেছে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট রাশিয়াকে সব ধরনের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা ভারত সফর করেছেন। রাশিয়া ও ভারত—এই দুই দেশই মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি যা-ই হোক, মিয়ানমার চীন থেকে সম্পূর্ণভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘ সীমান্ত ও বিদ্রোহের কারণে ভূকৌশলগত এই নরম-গরম সম্পর্ক বজায় থাকবে বলেই মনে হয়।

ওপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা পরিষ্কার যে বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটকে জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় ভারত, চীন বা রাশিয়া মোটেই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করছে না। বিশেষ করে, রাখাইন ও উত্তর মিয়ানমারে ভূকৌশলগত গুরুত্ব ও বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে প্রতিযোগিতার কারণে ভারত ও চীনের কাছে এই সংকটে বাংলাদেশের পক্ষ নেওয়ার চেয়ে মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য ও বিশ্লেষণে সেটাই দেখা যাচ্ছে। ভারতের একাধিক বিশ্লেষকও মনে করেন, বাংলাদেশের এ ক্ষেত্রে কিছু আশা করাও উচিত নয়।

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগাযোগ অথবা আরসা জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে—মিয়ানমারের এমন অবস্থানের সঙ্গে চীন প্রকাশ্যে সায় দেয়নি। কিন্তু এই অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপস্থিতিকে চীন বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করে। ‘উইঘুর’ অঞ্চলে মুসলিম বিদ্রোহীদের দমাতে চীন এখনো হিমশিম খাচ্ছে। কাজেই ভবিষ্যতে কোনো সময়ে রাখাইনে কাচিন, কারেন অথবা ওয়াহ স্টেট আর্মির মতো শক্ত বিদ্রোহী গ্রুপ দাঁড়ালে তা চীনের স্বার্থপরিপন্থী হবে। অন্যদিকে ভারতের বহু রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ভূকৌশল বিশেষজ্ঞ মনে করেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি ভবিষ্যতে জঙ্গি তৎপরতার জন্য সহায়ক হলে তা ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে।

রোহিঙ্গা প্রশ্নে এই তিন দেশ যে বাংলাদেশের পাশে থেকে মিয়ানমারকে চাপ দেবে না, তা প্রায় নিশ্চিত। এরপরও রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া এবং নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশের দাবির বিষয়ে অন্তত মধ্যস্থতার উদ্যোগে রাজি করাতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। এই তিন দেশকে বুঝতে হবে যে একটি দুর্বল জনগোষ্ঠীকে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে নিশ্চিহ্ন হতে দেওয়া যায় না।

যাহোক, রোহিঙ্গা ইস্যু যেমন বাংলাদেশের জন্য সংকট সৃষ্টি করেছে, তেমনি মিয়ানমারকে ঘিরে এ অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বাড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের রাখাইন ও রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং তেমন কিছু হলে এর মাশুল গুনতে হবে বাংলাদেশকে।

এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক।