রাস্তা থেকে বিশ্বকাপে

বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলার স্বপ্ন কার না থাকে। নিজ দেশের হয়ে বিশ্বকাপে ফুটবলে খেলা প্রত্যেকটা ফুটবলারের লালিত স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্নকেই বা ধারণ করতে পারেন কতজন? অদম্য মানসিকতা, ধৈর্য এবং প্রতিনিয়ত লড়াই করার মানসিকতাই পারে একজন ফুটবলারকে বিশ্বকাপে নিয়ে আসতে। এদিক থেকে সবার রোল মডেল হতে পারেন ব্রাজিলের মাত্র ২১ বছর বয়সী ফুটবলার গ্যাব্রিয়েল হেসুস। চার বছর আগে হওয়া ব্রাজিল বিশ্বকাপের সময় নিজ এলাকাতে বিভিন্ন জায়গায় দেয়ালে রঙ দিয়ে খেলোয়াড়দের ছবি এঁকেছিলেন হেসুস। আর এখন তিনিই ব্রাজিলের বিশ্বকাপ দল।

হেসুসের যাত্রাটা অন্য সবার মত তেমন সহজ ছিল না। পাঁচ বছর বয়সে সারাদিনই মাঠের বাইরে ফুটবল খেলতেন। তার মা ভেরা লুসিয়া জানান, সকাল থেকে একদম সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে রাস্তায় ফুটবল খেলতেন হেসুস। ব্রাজিলিয়ানদের রক্তেই ফুটবলার হওয়ার নেশা মিশে আছে। এজন্য হেসুসও ছোট্ট বয়সে সেই পথেই হাটেন। পড়াশুনা শুরু করার পর খুঁজতে থাকেন কোথায় গেলে নিজের দক্ষতাকে আরো উন্নতি করতে পারবেন।

দক্ষিণ আমেরিকানদের ফুটবলীয় মর্যাদা অনুসারে তার স্কুলের স্টেডিয়ামও ছিল অসাধারণ। সাও পাওলো থেকে রোমাও গোমেস মিলিটারি প্রিজনের ভেতর অবস্থিত প্যাকুয়েনিনোস ক্লাবে খেলতে যেতেন হেসুস। কিশোর হেসুসের ধন্যবাদ জানানো উচিৎ তার প্রথম কোচ হোসে মামেদেকে। কেননা তার কারণেই হেসুস সুযোগ পেয়েছিলেন নিজের প্রতিভা প্রমাণের।

রাস্তার কংক্রিটের উপর বল নিয়ে তার নানা টেকনিকের ছবি এলাকায় বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তার এমন অসাধারণ দক্ষতার জন্য ‘তেতিনহা’ ডাক নামেও ভূষিত হন হেসুস। তেতিনহার অর্থ ‘যে বল নিয়ে খুব কঠিন কসরত এবং কঠিন গোলগুলো অনায়াসে খুব সহজেই করতে পারেন।’ হেসুসের ভেতর ছিল সেই প্রতিভা।

যুব টুর্নামেন্টে তার জ্বলজ্বলে পারফরম্যান্সের পর সবাই জেনে যায় তার সম্পর্কে। তখনই পেয়ে যান ‘স্টার খেলোয়াড়ের’ তকমা। তার কাছে চলে আসে নিজেদের হারিয়ে খুঁজতে থাকা ব্রাজিলের অন্যতম সেরা ক্লাব পালমেইরাস। মূলত ক্লাবের পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতেই হেসুসকে দলে নিয়ে নেয় পালমেইরাস। ২০১৩ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে হেসুসকে দলে টানে তারা। ওইটুকু বয়সে অতোবড়ে ক্লাবে যোগ দিয়ে হেসুস বনে যান এলাকার হিরো। তাকে নিয়ে এলাকাতে বিশাল মিছিলও করে তার বন্ধুরা।

তার আগমন পালমেইরাসের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। নিজের প্রথম মৌসুমেই ক্লাবকে জেতান কোপা দো ব্রাজিল শিরোপা। ২০১৫-১৭ মৌসুমে হেসুস এবং তার বন্ধু ভারদাও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন ক্লাবের হয়ে। মাত্র পাঁচটি ম্যাচ খেলার সুযোগ হলেও গোল করেন সাতটি। তখনই তাকে দলে ভেড়াতে নেমে পরে বিশ্বসেরা ক্লাবগুলো। ২০১৬ সালের আগস্টে ২৭ মিলিয়ন পাউন্ডে তাকে দলে টেনে নেয় ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি।

ম্যান সিটির সঙ্গে চুক্তি হলেও শর্ত ছিল ওই মৌসুম পুরোটা পালমেইরাসের হয়ে খেলেই তারপর সিটিতে যাবেন তিনি। এই সিদ্ধান্তটি ক্লাবের জন্য বয়ে আনে বড় সাফল্য। ক্লাবকে দুই দশকের ভেতর প্রথমবারের মত লিগ জিততে সাহায্য করেন হেসুস। ক্লাবের হয়ে শেষ ম্যাচে সতীর্থদের ভালোবাসায় সিক্ত হন হেসুস। সবাই তাকে আকাশে ছুঁড়ে উল্লাস করে।

ম্যান সিটিতে যোগ দিয়েই পেপ গার্দিওলার অন্যতম সেরা অস্ত্রে পরিণত হন। সিটির ১০০ পয়েন্টের লিগ অর্জনের মৌসুমে শেষ গোলটিও আসে তার পা থেকে। তার উপর আস্থা রেখেছেন ব্রাজিলিয়ান কোচ তিতেও। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে স্বাগতিকদের লজ্জার হার উপহার দিয়েছিল জার্মানি। সেটি থেকে উতরাতে এবার তার কাঁধেই ভরসা রাখতে চান ব্রাজিলিয়ান কোচ।

কিন্তু এতসব কিছু সম্ভব হতো না যদি না তার মা ভেরা লুসিয়া তাকে সাহায্য না করতেন। ছেলের সাফল্যের পেছনের মূল কারিগর যে তিনি। একা হাতেই নিজের চার সন্তানকে মানুষ করেছেন লুসিয়া। সাও পাওলোতে পরিচ্ছনতাকর্মী হিসেবে সারাদিন কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন তবুও সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করে গেছেন তিনি। লুসিয়ার প্রথম তিন সন্তানের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন হেসুস। মায়ের ভালোবাসাকে সব সময়েই মনে করেন এই ফুটবলার। যখনই কোন গোল করেন তখনই হাত উঁচিয়ে কানের কাছে নেন ফোন কল করার মত। যেখানে তিনি তার মাকে কল করছেন বলে বোঝাতে চান।

মায়ের একটি ট্যাটুও এক হাতে এঁকেছেন হেসুস। প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার সবকিছুর জন্য মায়ের কাছে আমি ঋণী। ব্রাজিলে অনেক বাচ্চারা আছে যারা পরিবারের সাথে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা ফুটবল খেলতে পারে না, স্কুলে যেতে পারে না, কাজ করতে পারে না। তাদের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন তখনই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আমার মা আমাকে বিশ্বাস করেছেন। আমি যাই করি না কেন, তিনি আমাকে বিশ্বাস করতেন। আমাকে বলতেন, তুমি এগিয়ে যাও, কি হলো না হলো সেটা নিয়ে ভাবার দরকার নেই।’ ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারলে হয়তো সেই বিশ্বকাপ ট্রফিটি জন্মদাত্রী মাকেই উৎসর্গ করবেন হেসুস।