রিজভীকে সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের খোলা চিঠি

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে খোলা চিঠি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন। গত ১৬ তারিখে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত রিজভীর একটি বক্তব্যের সূত্র ধরেই এই চিঠি পাঠান সাবেক এই মন্ত্রী। আবুল হোসেন অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় বিএনপি নেতাকে ‘শ্রদ্ধেয় রিজভী সাহেব’ বলে সম্বোধন করেন। রিজভীকে ‘সৎ, ভাল মানুষ হিসেবে জানি’ বলেও মন্তব্য করেন।

পাঠকদের জন্য খোলা চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

শ্রদ্ধেয় মহোদয়,
আসসালামু আলাইকুম।
বিভিন্ন পত্রিকায় ১৬ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় প্রকাশিত আপনার উদ্ধৃতি দিয়ে খবরের একাংশ আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আপনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে বলেছেন- ‘পদ্মা সেতুতে সুনির্দিষ্টভাবে একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি বিদেশী আর্থিক সংস্থা অভিযোগ তুলল এবং সেই সংস্থা এখন পর্যন্ত অভিযোগ প্রত্যাহার করেনি আর আপনি তাকে বললেন- দেশপ্রেমিক। স্পষ্টত এ বক্তব্যটুকু আমাকে ইঙ্গিত করে বলেছেন। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় যে কোন দুর্নীতি হয়নি- তা বিশ্বব্যাপী আজ প্রমাণিত সত্য। আমি যে কোন অন্যায় পথ বা অবৈধ পথ গ্রহণ করিনি, কোন দুর্নীতির প্রশ্রয় দেইনি, যথাযথভাবে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন কাজ এগিয়ে নিয়েছিলাম- তা আজ অকাট্য সত্য।
শ্রদ্ধেয় রিজভী সাহেব, বিশ্বব্যাংক শুধু আমার কাছে নয়, বিশ্বের কাছে লজ্জিত। পদ্মা সেতুর মতো একটি ঐতিহাসিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ হারিয়ে সংস্থার কর্মকর্তারা হতচকিত ও বিমূঢ়। দেশীয় স্বার্থান্বেষী গ্রুপের অসত্য অভিযোগ আমলে নেওয়া যে তাদের ভুলপথে চালিত করেছে- তা তারা বুঝতে পেরেছে। পদ্মা সেতু বিষয়ে আমাকে জড়িয়ে তাদের উত্থাপিত অভিযোগ এতো অসত্য ছিল যে, তা আদালতের গাল-গল্পের সামিল বলে রায় এসেছে। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রর্বাট জুলিকের সাথে চায়নায় ‘বোয়া ফোরামে’ আমার সাক্ষাত হয়েছিল। তার সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
শ্রদ্ধেয় রিজভী সাহেব, আপনি একজন ছাত্র নেতা ছিলেন। আপনি বিএনপি’র একজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতা। আপনার ছাত্র জীবন থেকে আমি আপনাকে সৎ, ভাল মানুষ হিসেবে জানি। এখনো তা বিশ্বাস করতে চাই। শুধু রাজনীতির জন্য আমার মতো একজন নির্দোষ ব্যক্তি, নিরাপরাধ ব্যক্তি আপনার রাজনীতির গুটি হবে- তা বিশ্বাস করতে চাই না। আপনি বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়ে, যে বিশ্বব্যাংকের অন্যায়ের কাছে, অন্যায় টিকটেশনের কাছে যিনি মাথা নত করেনি, দেশের স্বার্থে, পদ্মা সেতুর নির্মাণের স্বার্থে যিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছে- তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন- কেন তা বুঝি না? শুধু কি রাজনীতি? এ ধরনের রাজনীতি আপনার কাছ থেকে কাম্য নয়।
শ্রদ্ধেয় রিজভী সাহেব, আপনি হয়তো জানেন, আমি আমার প্রতিবাদে, বক্তব্যে বিভিন্ন সময়ে বলেছি, আমার প্রতি একটি ভুল ধারণা নিয়ে স্বার্থান্বেষী গ্রুপ বক্তব্য দিচ্ছেন। কতিপয় পত্রিকায় অহেতুক অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রচারণা চালিয়েছেন। আমি কোন অন্যায় করিনি। বৈধ পথে অর্থ উপার্জন করেছি। সরকারকে নিয়মিত কর দিয়েছি। কর পরিশোধিত অর্থে স্কুল-কলেজ নির্মাণ করেছি। অসহায় ও দুঃস্থ মানুষের সেবা করেছি। রাজনীতিতে আসার পর থেকে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়েছে। স্বার্থান্বেষী গ্রুপ ও কতিপয় পত্রিকার অপপ্রচার আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা করেছে। ফলশ্রুতিতে বিএনপি’র আমলে প্রকাশিত শ্বেতপত্রে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু সার্বিক তদন্তে আপনাদের শাসনামলেই তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ১/১১ সময়ও আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এসব অভিযোগ তদন্ত, পুনঃতদন্ত হয় এবং আমি নিরাপরাধ বলে প্রমাণিত হই। আমার এ বক্তব্য একটুকুও মিথ্যা নয়- সরকারি দলিলে তা প্রমাণিত এবং সত্য।

শ্রদ্ধেয় রিজভী সাহেব, আমি কখনো কারো বিরুদ্ধে কথা বলি না। কারো সাথে অশোভন আচরণ করি না। আমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি। দেশকে ভালবাসি। আমি বিশ্বাস করি, আপনি একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে, দেশের সন্তান হিসেবে দেশকে ভালবাসেন। গ্রামের বাড়ী মাদারীপুরের ডাসার-কালকিনিতে আমি বাড়ি করেছি। স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এলাকাকে সুন্দরভাবে সাজিয়েছি। রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করেছি। সন্ত্রাসী জনপদ-কে উন্নয়ন ও শান্তির জনপদে রূপান্তর করেছি। এলাকার শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষা প্রসার ও স্কুল-কলেজ- মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন কি দেশপ্রেমের পরিচয় নয়? আমার গ্রামের, আমার এলকা ও জেলার দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ, আমি অত্যন্ত খুশী। কাজেই আমার দেশপ্রেমিকতা নিয়ে কটাক্ষ বা কারো দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ- সমীচীন কিনা- তা ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।
শ্রদ্ধেয় রিজভী সাহেব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেশপ্রেমিক হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি নিয়ে আপনি কটাক্ষমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এ বক্তব্য আমার জন্য দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করি। আমি সারাজীবন মানবসেবা এবং মানবকল্যাণকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছি। আপনি যদি কখনো আমার গ্রাম আমার এলাকা ডাসার-কালকিনি-মাদারীপুর পরিদর্শন করেন, তা হলে আমার সেবার ক্ষেত্র প্রত্যক্ষ করবেন। আমি সমাজসেবা এবং রাজনীতির পাশাপাশি একজন লেখকও বটে। আমার সৃষ্টিশীল লেখার অধিকাংশই দেশ ও জাতিগঠন এবং মানবিকমূল্যবোধ ও দেশপ্রেম সম্পর্কিত। সাম্প্রতিক সময়ে আমার লেখা- ‘আমার কথা’ বইয়ে আমার চিন্তা-চেতনা, স্বপ্ন ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে। একজন সুনাগরিক হিসেবে, দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেকে গড়তে হলে এ গ্রন্থটি সকলের জন্য পাঠযোগ্য। গ্রন্থটি পড়ার জন্য আপনার নিকট প্রেরণ করা হলো।
মাতৃভূমি, দেশপ্রেম- মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার আল্লাহ প্রদত্ত। এ অধিকার জীবনকে গৌরবান্বিত করে। একজন মানুষকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দেয়। আমি বাঙালি, আমি বাংলাদেশী – এটা আমার গর্ব, আমার অহংকার। অবশ্য এ বোধ আপনারও। আসুন, আমরা প্রতিজন বাংলাদেশীর এ বোধের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা আরো সমুন্নত করি।
শ্রদ্ধেয় রিজভী সাহেব, একথাগুলো আমার অভিযোগ নয়। আমার একথাগুলো আপনার বিবেক এবং আপনার সৎ ভাবনা ও কর্মের খোরাক হিসেবে উপস্থাপন করেছি। সত্য ঘটনা জানানোর জন্য, সত্য কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য আমার এ লেখা। আমি সব সময় বিশিষ্টজন ও শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শকে গুরুত্ব দিই। আল্লাহর কাছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাবদিহিমূলক জীবন গড়ে তুলতে চাই যা প্রত্যেক দেশপ্রেমিক ও সৎ মানুষের কাম্য।
আপনার সুস্থ ও সুদীর্ঘ জীবন কামনা করি।
গভীর শ্রদ্ধান্তে,
একান্তভাবে আপনার,
( সৈয়দ আবুল হোসেন )