রূপপুর প্রকল্পে বড় অংকের অর্থছাড় করছে রাশিয়া

চলমান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য ঘোষিত বড় অংকের অর্থছাড় করছে রাশিয়া। চলতি মাসেই মোট প্রতিশ্রুতির ৪০০ কোটি টাকা ছাড় করবে দেশটি। এর মাধ্যমে প্রকল্পের কাজে আরও গতি আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্প নির্মাণে চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজের উদ্বোধন করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, ডিসেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৫০ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থছাড় করবে রাশিয়া। এর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো অর্থ সংকট থাকবে না। বাড়বে কাজের গতি। অন্যদিকে উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড়ের যে টার্গেট, তাও সহজে পূরণ হবে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ব্যয়ের প্রকল্প হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ১৮ হাজার ১৮০ কোটি ৮১ লাখ টাকা। মোট এ ব্যয়ের মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে রাশিয়া দিচ্ছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, এ প্রকল্প উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে নতুন দিগন্তের আরেক মাইলফলকে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সার্বিক কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। ইতোমধ্যে প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার ৮৭ কোটি নয় লাখ টাকা। এর মাধ্যমে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে।

আলোচিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাস্তবায়নে কাজ করছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভিভিইআর-১২০০ (এইএস-২০০৬) রিঅ্যাক্টরের দুটি বিদ্যুৎ ইউনিটের (ইউনিট-১ ও ২) সমন্বয়ে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।

প্রকল্প পরিচালক ড. শওকত আকবর জানান, প্রথম পর্যায়ের প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। এ পর্যায়ের ব্যয় ধরা হয়েছিল পাঁচ হাজার ৮৭ কোটি নয় লাখ টাকা। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল প্রকল্পে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়েছে। এ পর্যায়ের ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যা এখন পুরোদমে চলছে। গত ৩০ নভেম্বর এ অংশের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

দুই পর্যায় মিলে এক লাখ ১৮ হাজার ১৮০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালে। প্রকল্প সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর।

পাবনার রূপপুরে পদ্মা নদীর পাড়ে রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি কর্পোরেশন (রসাটমের) নেতৃত্বে চলছে মহাকর্মযজ্ঞ। বর্তমানে মূল স্থাপনার জন্য সয়েল স্টাবলিস্টমেন্টের কাজ পুরোদমে চলছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মাটি তুলনামূলক নরম হওয়ায় যন্ত্রের সাহায্যে মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত সিমেন্ট মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে ১৭ হাজার ৪৫০ কিউবিক মিটার কংক্রিটিংয়ের কাজ চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। প্রথম পর্যায়ে চার হাজার কিউবিক মিটারের কাজ শেষ হয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারির মধ্যেই পুরোটা শেষ হবে। মূল স্থাপনার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে ৭০ মিটার করে, আর ফাউন্ডেশনের থিকনেস হবে তিন মিটার।

এ বিষয়ে প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ইউরিক মিখাউল খোসলেভ বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বছরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই রিঅ্যাক্টর বিল্ডিং তৈরির প্রস্তুতি হিসেবে সাব-বেইজ তৈরি করা হয়েছে। সেইসঙ্গে তৈরি হয়েছে মূল প্রকল্পের ভিত্তি।

প্রতিদিন রাশিয়ার বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশি কর্মী মিলে প্রায় এক হাজারের বেশি কর্মী দিন-রাত কাজ করছেন। এ প্রকল্পের জন্য থ্রি প্লাস রিঅ্যাক্টর বসানো হয়েছে। যেটি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও আধুনিক প্রযুক্তি। যা শুধু রাশিয়ার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে রয়েছে। আর বাংলাদেশের রূপপুরেই হবে দ্বিতীয় ব্যবহার। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর মূল স্থাপনার কাজ শুরু হলে এর পরের ৬৮ মাসের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের মাধ্যমে পাওনিয়ার বেইজ ও ইরেকশন বেইজের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এছাড়া চলছে প্রটেকশন ড্যাম (বাঁধ) তৈরির কাজ। দুই দশমিক আট কিলোমিটার লম্বা এবং ১৩ মিটার প্রস্থ এ বাঁধের কাজও এগিয়েছে অনেক দূর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথম পর্যায়ে ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা ছিল। কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত না হওয়ায় ইতোমধ্যে মোট ৮০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া আরো ২১৯ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

অন্যদিকে, নতুনভাবে অধিগ্রহণ করা পদ্মার বিশাল চরে চলছে মাটি ভরাটের কাজ। মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী নির্মাণের কাজ অনেকটাই শেষ পর্যায়ে। পাবনা গণপূর্ত অধিদফতর এগুলো বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে তিনটি সুউচ্চ ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। এ এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২০তলা ১১টি ভবন ও ১৬তলা আটটি ভবনের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। ২২টি সুউচ্চ ভবন তৈরি হবে এ চত্বরে। এছাড়া থাকবে মাল্টিপারপাস হল, মসজিদ ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা। সবমিলে এ প্রকল্পের কাজ অনেকদূর এগিয়েছে।

চলমান কাজের অগ্রগতি বিষয়ে প্রকল্পের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মিজানুর রহমান বলেন, নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে এ রূপপুরে। এটি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে মাইলফলক হবে বলে মত তার।